শিক্ষককুলের রবি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের বাংলা জীবনী.
দক্ষিণ
ভারতকে মানব মনীষার অন্যতম কেন্দ্র ভূমি বলা হয় । ভারতের সংস্কৃতিতে দক্ষিণ ভারতের
অবদান কোনোদিন অস্বীকার করা যাবেনা । দক্ষিণ ভারত থেকে একাধিক মহান ব্যক্তির
আবির্ভাব ঘটেছে । বর্তমানে চেন্নাই শহরের কাছে তিরুতানি নামে একটি ছোটো গ্রামে
১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর রাধাকৃষ্ণন
জন্ম গ্রহণ করেন । তিনি ছিলেন দক্ষিণ ভারতের সুসন্তান, মহান দার্শনিক ও
রাষ্ট্রনায়ক । তাঁর বাবার নাম সর্বপল্লী
বীরেস্বামী ও মায়ের নাম
সীতাম্মা । তাঁর বাবা স্থানীয় জমিদারের কাছে কাজ করতেন ।
রাধাকৃষ্ণনের পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিলনা । এক মধ্যবিত্ত গোঁড়া তেলেগু ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন । দরিদ্রতা থাকলেও পরিবারের মানুষ জন পড়াশোনা ভালবাসতেন । ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন বইয়ের পোকা । তাঁর বন্ধুরা যখন মাঠে খেলতেন, তিনি একা একা বই পড়তেন । রাধাকৃষ্ণনের মা তাঁর এই ছেলের দিকে বিশেষ নজর দিতেন । কারণ – রাধাকৃষ্ণন ছিলেন উদাসীন, জগতের কোনও বস্তু তাকে বিশেষ আকর্ষণ করেনা । বইয়ের জগত ছাড়া অন্য কোনও জগত তাঁকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করেনা । তিনি তাঁর ছেলের এই বই পড়ার নেশা দেখে অবাক হয়ে যেতেন ।
রাধাকৃষ্ণন
তিরুতানি শহরে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন । এরপর তিনি আসেন তিরুপতি শহরে
। এখানে তিনি ১৮৯৬-১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্রিশ্চান মিশনারির ছাত্র ছিলেন ।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভেলোর কলেজে ভর্তি হন ও চার বছর সেখানে পড়াশোনা করেন । এরপর
মাদ্রাজ শহরের ১৯০৪-১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ক্রিশ্চান কলেজের কৃতি
ছাত্র । ছোটো থেকে তিনি প্রশ্ন করতে ভালোবাসতেন, তাঁর প্রশ্ন শুনে শিক্ষকরাও অবাক
হয়ে যেতেন । তাঁরা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে এই মানুষটি একদিন আন্তর্জাতিক খ্যাতি
অর্জন করবেন ।
স্বভাবে তিনি ছিলেন লাজুক ও আত্মকেন্দ্রিক । লাইব্রেরীতে বসে থাকতে তিনি
খুব ভালবাসতেন । প্রথমে তিনি বিভিন্ন রকমের বই পড়তেন । সবেমাত্র তিনি স্মাতক
হয়েছেন, তাঁর এক আত্মীয় ভাই তাঁকে একদিন কিছু দর্শনের বই উপহার দিয়েছিলেন ।
সারারাত জেগে তিনি সেই বইগুলি পরলেন ও তন্ময় হয়ে গেলেন । তাঁর জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের
সূচনা হল । তিনি স্থির করলেন যে – দর্শনশাস্ত্র ছাড়া তিনি অন্য কিছুতে মন দেবেন না
। তখন
থেকে তিনি দর্শনশাস্ত্রকে তাঁর জীবনের
রূপরেখা নির্ধারণ করেন ।
১৯০৯
সালের এপ্রিল মাসে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক নিযুক্ত হন ।
ছাত্রছাত্রীরা এমন শিক্ষক পেয়ে খুশি হয়েছিল । এরকম দেখা গেছে যে - অন্যান্য ক্লাসের ছাত্ররাও তাঁর ক্লাসে ভিড়
করেছে, বসার জায়গা নেই, তবুও করিডরে দাড়িয়ে আছে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য । সাত বছর তিনি এখানে
অধ্যাপনা করেন । ১৯১৮ সালে তিনি মাইসোর বিশ্ব বিদ্যালয়য়ে যোগদান করেন । ১৯২২ সালে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের
আমন্ত্রণে কলকাতায় আসেন । এখানে তিনি পঞ্চম জর্জের নামাঙ্কিত ‘প্রোফেসর অব ফিলজফি’
নামে দর্শন বিভাগের পদে রাধাকৃষ্ণন যোগদান
করেন ।
১৯২৫
সালে তিনি ভারতীয় দর্শন ‘কংগ্রেস’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন । ১৯২৫ সালে জুন
মাসে লন্ডনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় গুলির দর্শন কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিল ।
একই বছর সেপ্টেম্বরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক দর্শন কংগ্রেস অনুষ্ঠিত
হয়েছিল । এগুলিতে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন । এরপর বিভিন্ন বিদেশ থেকে তাঁর ডাক আসে
। বিদেশের মাটিতে তিনি একাধিক সারগর্ভ বক্তৃতা দিয়েছিলেন । বিদেশের বিভিন্ন
শিক্ষাকেন্দ্রে কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, চিকাগো, হার্ভার্ড ইত্যাদি থেকে তাঁকে
সংবর্ধনা দেওয়া হয় ।
১৯৩৩ সালে তিনি অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হন । ১৯৩৬-১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের Eastern Religion And Ethis এর সম্মানিত অধ্যাপকের
পদ অলংকৃত করেন । ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকার
তাঁকে স্যার উপাধি দিয়ে ভূষিত করেন । ১৯৩৯ সালে ইংল্যান্ডের রয়্যাল অ্যাকাডেমির
মাননীয় সদস্য হয়েছিলেন ।
১৯৪৬
সালে ইউনেস্কোর ভারতীয় প্রতিনিধি হিসাবে তাঁকে নির্বাচন করা হয় । ১৯৪৮ সালে রাধাকৃষ্ণন
ইউনেস্কোর চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন । তিনি একই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা
কমিশনের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । তিনি এবার রাজনৈতিক জগতে প্রবেশ করলেন ।
১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসাবে ছিলেন । পণ্ডিত
জওহরলাল নেহেরুর একান্ত ইচ্ছাতে তিনি এই পদ গ্রহণ করেন । এবার আমরা তাঁকে পত্যক্ষ
রাজনীতিতে দেখতে পাই । ১৯৫২ সালে তিনি ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন
। ভারত সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সমস্যা আছে । তিনি
তাঁর অসাধারণ বাস্তববোধ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দ্বারা তাঁর দায়িত্ব সুন্দর ভাবে পালন
করেন । ১৯৫২-১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি উপরাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন । এই সময়ে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যক্ষ পদও অলংকৃত করেন । ১৯৬২ সালে তিনি ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসাবে
নির্বাচিত হন ।
১৯৬৪ সালে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যু হলে
তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে বসতে পারতেন, কিন্তু তিনি ক্ষমতালোভী ছিলেন না । রাষ্ট্রপতি
হিসাবে থাকতে চেয়েছেন । রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিনি কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করেন এবং সকলের কাছে প্রশংসিত হয়েছিলেন । বেতন হিসাবে তিনি যে ১০ হাজার টাকা
পেতেন, তাঁর মধ্যে ২ হাজার টাকা নিজের খরচের জন্য রেখে বাকী টাকা দেশ গড়ার তহবিলে
দান করেন । তিনি সারা জীবন সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন । ১৯৬৭ সালের ৯ মে রাষ্ট্রপতি
পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন ।
তিনি লেখক হিসাবেও সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন ।
তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থ যেমন – ভারতীয় দর্শন, পূর্ব-পশ্চিম, সমকালীন দর্শনে ধর্মের
স্থান ইত্যাদি । তাঁর জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয় ।
ভারতরত্ন পুরষ্কার তিনি লাভ করেছিলেন । ১৯৭৫ সালে তিনি ১৬ এপ্রিল রাত ১২ টা ৪৫
মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোনও প্রশ্ন থাকে তবে নিচে
কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন ।
জীবনী বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে জীবনী লেখাটির উপর ক্লিক করুন । পুরো পোস্টটি
পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে আপনার প্রয়োজন অনুসারে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।
নাইস
উত্তরমুছুন