মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জীবনী, শাসন, সাম্রাজ্য ব্যবস্থা কেমন ছিল ?.
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শেষদিকে মৌর্যদের
আবির্ভাবের সাথে ভারতের ইতিহাসে অন্ধকার পার হয়ে আলোয় উত্তীর্ণ হয় । চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪-৩০০) ছিলেন মৌর্য বংশের প্রথম সম্রাট । পূর্বে নন্দ
রাজাগণ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন । সেই সময় সাম্রাজ্য সঠিক ভাবে চালানোর গুরু
দায়িত্ব পালনের জন্য ভারতের ইতিহাসে একজন বীরপুরুষের প্রয়োজন ছিল । এই যুগ
সন্ধিক্ষণে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে সিংহাসনে আরোহণ করে বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে
হয়েছিল । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সিংহাসনে আরোহণের সঠিক তারিখ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে ।
জৈন পরিশিষ্ট পার্বণ অনুসারে – তিনি মহাবীরের সিদ্ধিলাভের ১৫৫ বছর পরে সিংহাসন
আরোহণ করেন । অপর জৈন লেখক মেরু তুঙ্গের মতে – তিনি মহাবীরের সিদ্ধিলাভের ৬০ বছর
পরে সিংহাসন আরোহণ করেন । এর থেকে বোঝা যায় যে এইসব উপাদান নির্ভরযোগ্য নয় । প্রাচীন
গ্রীক ও ল্যাটিন লেখকদের থেকে জানা যায় যে – তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ অব্দ নাগাদ
সিংহাসন আরোহণ করেন ।
চন্দ্রগুপ্তের পূর্বপুরুষ ও কৈশোর সম্বন্ধে
খুব কম তথ্যই পাওয়া যায় । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বংশ পরিচয় সম্পর্কে বিভিন্ন
মতভেদ আছে । মৌর্য শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে আবার সকলে একমত নয় । মনে করা হয় যে – এই
মুরা ছিলেন কোন শূদ্র বংশীয় ও কোন নন্দ রাজার পত্নী । পুরাণে মুরা নামের কোন
উল্লেখ নেই । মৌর্যদের সাথে তাঁদের কোন পারিবারিক সম্পর্কের কথা জানা যায় না । তাই
এই মতামত সমর্থন যোগ্য নয় । ঐতিহাসিক জাস্টিন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে সামান্য বংশজাত
বলেছেন । বৌদ্ধ লেখক গন মৌর্য শব্দটি একটি সামান্য গোষ্ঠীর নাম হিসাবে ব্যবহার
করেছেন । মহাবংশটীকা অনুসারে, তাকে শাক্য ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে । বৌদ্ধ
গ্রন্থ মহাবংশে চন্দ্রগুপ্তকে মোরিয় নামক একটি ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর সন্তান বলে উল্লেখ
করা হয়েছে ।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সম্বন্ধে জানতে
আমরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদানের সাহায্য নিয়ে থাকি । সে গুলি হল – সাহিত্য উপাদান,
অশোকের লেখ, মহীশূর লেখ, জুনাগড় স্তম্ভ লেখ । বিদেশি সাহিত্যিকদের মধ্যে – নিয়ারকাস, ওনেসিক্রিটাস ও এরিসটোবুলাসের লেখা
থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্বন্ধে জানা যায় । মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থ থেকে
আমারা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানতে পারি । মেগাস্থিনিসের মূল
গ্রন্থ ‘ইন্ডিকা’ পাওয়া যায়নি । এছাড়াও স্ট্রাবো, প্লিনি, ডায়ডোরাস, অ্যারিয়ান ও
জাস্টিনের নাম উল্লেখযোগ্য । বিদেশি সাহিত্য ছাড়া ভারতীয় বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য থেকে
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায় ।
বৌদ্ধ সাহিত্য অনুসারে - চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্যের পিতা একজন মোরিয় গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন । সীমান্ত সংঘর্ষে তাঁর মৃত্যু হয় ।
তখন তাঁর স্ত্রী অসহায় অবস্থায় পাটলিপুত্রে চলে আসেন । এখানে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের
জন্ম হয় । চাণক্য বা কৌটিল্যের সাহায্যে তিনি তক্ষশীলায় গিয়ে শিক্ষালাভ করেন । দুইজনে মিলে নন্দ সম্রাট ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন । তিনি আলেকজান্ডারের কাছে নন্দ বংশ উচ্ছেদ করার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন । কিন্তু,
আলেকজান্ডার তাঁকে সাহায্য না করে চন্দ্রগুপ্তকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন । চন্দ্রগুপ্ত
সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে বনাঞ্চল ও অন্যান্য স্থান থেকে লোকজন সংগ্রহ করে একটি
সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী গঠন করেন । জৈন পরিশিষ্ট পার্বণ অনুসারে - চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য
নন্দবংশ উচ্ছেদ করার জন্য তাঁর সৈন্যদল গঠন করেছিলেন ।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কিভাবে নন্দবংশ
উচ্ছেদ করেছিলেন সমসাময়িক বিবরণ থেকে তাঁর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না । পাটলিপুত্র নগরী অবরোধ করে ৩২১ খ্রিটপূর্বাব্দে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে নন্দ সাম্রাজ্য অধিকার করেন বলে জানা যায় । উত্তর-পশ্চিম
ভারতে আলেকজান্ডারের সেনাপতিদের পরাজিত করে পাঞ্জাব ও সিন্ধুর স্বাধীনতা
পুনরুদ্ধার করা চন্দ্রগুপ্তের দ্বিতীয় সাফল্য । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বকালের
শেষ দিকে সেলুকাসের সাথে তাঁর যুদ্ধ হয় । সেলুকাস প্রথমে আলেকজান্ডারে সেনাপতি
ছিলেন । উভয়ের মধ্যে সন্ধি ও বিবাহ সম্পর্কিত চুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধ সমাপ্ত হয়
। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সেলুকাসকে ৫০০ হাতি উপহার দেন । সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে হেরাত,
কান্দাহার, কাবুল ও দক্ষিণ বেলুচিস্তান হস্তান্তরিত করেন । সেলুকাস মেগাস্থিনিস কে
পাটলিপুত্রে দূত হিসাবে পাঠান । যুদ্ধের শেষে বিবাহ সম্পর্কিত চুক্তি ও অঞ্চল গুলি
হস্তান্তর সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে । চন্দ্রগুপ্ত ও সেলুকাসের
মধ্যে প্রকৃত বিবাহ চুক্তি হয়েছিল কিনা তা সঠিক ভাবে বলা যায় না ।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জৈন ঐতিহ্য অনুসারে
শেষ জীবনে সংসার ত্যাগ করেন । জৈন আচার্য্য ভদ্রবাহুর নিকট চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্য্য আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন, ভদ্র বাহুর নেতৃত্বে তিনি জৈন অভিপ্রায়ে অংশ নিয়ে মহীশূরের শ্রাবণ জেলায় আসেন
। সে সময়ের প্রচলিত জৈন রীতি অনুসারে অনশনে তিনি প্রাণ ত্যাগ (খ্রিস্টপূর্ব-৩০০)
করেন । মেগাস্থিনিসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে – তিনি গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্মের
পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । অন্যান্য সম্রাটদের মত তিনি পূজা বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন ।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন ব্যবস্থা
জানার জন্য আমরা প্রধানত মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’ ও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এর উপর
নির্ভর করি । এছাড়াও অশোকের লেখ, জুনাগড় শিলালেখ, মুদ্রারাক্ষস, বৌদ্ধ ও জৈন
গ্রন্থের গুরুত্ব রয়েছে । পাটলিপুত্র নগরীর রাজপ্রাসাদ গ্রীকদের প্রশংসা অর্জন
করেছিল । এই প্রাসাদটি ছিল কাঠ দিয়ে তৈরি । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এই প্রাসাদের
অভ্যন্তরে রণরঙ্গিণী নারী দেহরক্ষী পরিবৃত হয়ে বিলাসী জীবন যাপন করতেন । মেগাস্থিনিস
গঙ্গা ও শোন নদীর সংগম স্থলে অবস্থিত পাটলিপুত্রকে ভারতের বৃহত্তম নগর বলে উল্লেখ
করেছেন । সমুদ্র বা নদীর তীরে অবস্থিত শহর গুলি কাঠের তৈরি, ও দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত
শহর গুলি ইটের তৈরি ছিল ।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রাদেশিক শাসনের
উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করার বিশেষ ব্যবস্থা করেন । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের
সময় প্রদেশগুলির সংখ্যা কত ছিল, সঠিক জানা যায় না । অশোকের সময় মৌর্য সাম্রাজ্য -
উত্তরাপথ, অবন্তীপথ, দক্ষিণাপথ, কলিঙ্গ ও প্রাচ্য এই পাঁচটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল । শাসন
ক্ষমতায় তিনি সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন । শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করার জন্য
রাজার একটি ছোট উপদেষ্টা ছিল । এরা রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজাকে সাহায্য করতেন ।
তাঁরা প্রাদেশিক শাসন কর্তা, সেনাপতি, বিচারক, কোষাধ্যক্ষ, নৌবাহিনীর অধিনায়ক ও
অন্যান্য উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারীদের নির্বাচন করতেন । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়
কৃষি ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে
ছিল । মেগাস্থিনিস ও কৌটিল্যের মতে – সামান্য অপরাধে অনেক জরিমানা আদায় করা হত । শাস্তি
হিসাবে অঙ্গছেদ ও কারাবাসের ব্যবস্থা ছিল । ব্রাহ্মণদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত না ।
কিন্তু, রাজদ্রোহের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত ।
বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে রাজা নিজে
থাকতেন । রাজকীয় বিচারালয় ছিল সবার উপরে । সেখানে রাজা নিজে বিচার করতেন । এছাড়াও
শহর ও গ্রামাঞ্চলে দুই ধরনের বিচারালয় ছিল । শহরের বিচারালয়ে মহামাত্ররা বিচার
করতেন । গ্রামাঞ্চলে বিচার করতেন রজুকগন । ‘গ্রামিক’ গ্রামের বৃদ্ধদের সাহায্যে
ছোট ছোট মোকদ্দমার বিচার করতেন । শাসন ব্যবস্থায় সর্বনিম্ন ও ক্ষুদ্রতম একক ছিল
গ্রাম । গ্রামবাসীরা নতুন দিঘী, নষ্ট পুকুর বা দিঘী পুনরুদ্ধার করলে তাঁদের কর
মকুব করা হত । গ্রামের উদ্বৃত্ত জমি ‘গ্রামভৃতক’ দের সাহায্যে চাষ করা হত । ডঃ
রায়চৌধুরির মতে – এরা ছিলেন গ্রামে নিযুক্ত সরকারের বেতনভুক কর্মচারী । আবার অনেকে
এদেরকে গ্রামের ক্রীতদাস বলে থাকেন।
আমাদের লেখা আপনার কেমন
লাগছে বা আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের
কাছে পোস্ট টি পৌঁছেদিতে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুণ । ইতিহাস বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে
নিচে ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুণ । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
।
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
ধন্যবাদ
মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷