গুপ্ত সম্রাট সমুদ্র গুপ্তের জীবনী, শাসন, রাজ্য জয় ও গুরুত্ব কি কি ?.
ভারতে গুপ্ত সম্রাটদের মধ্যে প্রধান ও শ্রেষ্ঠ গুপ্ত
শাসক হলেন সমুদ্র গুপ্ত । শুধু গুপ্ত বংশেরই নন, তিনি ছিলেন ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম
শ্রেষ্ঠ সামরিক শাসক । সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্তসম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও লিচ্ছবি
রাজকন্যা কুমারদেবীর সন্তান । সমুদ্র গুপ্ত সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানা যায় কিছু ঐতিহাসিক
উপাদানের সাহায্যে । আর্য-মঞ্জুশ্রী মুলকল্প ও তন্ত্রি-কামান্ডকে তাঁর উল্লেখ পাওয়া
যায় । এছাড়া সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রা থেকে তার রাজত্বের বহু তথ্য জানা যায় । সমুদ্র
গুপ্তের পাঁচটি বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা পাওয়া গেছে । প্রথম মুদ্রাতে তিনি তীর ধনুক সহ
দণ্ডায়মান, দ্বিতীয়টিতে তাঁর হাতে একটি কুঠার, পরেরটিতে তাঁর পদদলিত একটি বাঘ, এর পরেরটিতে
তিনি বীণা বাদনরত, শেষ মুদ্রাটিতে অশ্বমেধের স্মারক হিসাবে তাঁকে দেখা যায় ।
এই মুদ্রাগুলির
সাহায্যে তাঁর সর্বতোমুখী প্রতিভার কথা বলা হয়েছে । সমুদ্র গুপ্তের জন্য দুটি লেখ মূল্যবান,
সেগুলি হল – মধ্য প্রদেশে এরাণ লেখ ও এলাহাবাদে হরিষেণ প্রশস্তি । হরিষেণ প্রশস্তি
অশোক স্তম্ভের উপর রচিত । সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে
তার ও তার রাজ্যজয় ও রাজত্বকাল সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায় । সমগ্র গুপ্ত যুগের ইতিহাস
জানার জন্য এই লেখাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । হরিষেণ প্রশস্তির সপ্তম স্তবক থেকে সমুদ্র
গুপ্তের সামরিক সাফল্যের বর্ণনা পাওয়া যায় ।
সমুদ্র গুপ্ত কবে সিংহাসন আরোহণ করেছিলেম. । তার সিংহাসনারোহণের
বছর কোনটি – এই প্রশ্নে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে । ড. রায়চৌধুরি ৩২৫ খৃষ্টাব্দকে
সমুদ্র গুপ্তের সিংহাসন লাভের তারিখ বলেছেন । আবার ড. মজুমদার মনে করেন- ৩৫০ খৃষ্টাব্দ
বা তাঁর কাছাকাছি সময়ের আগে সমুদ্র গুপ্ত সিংহাসন লাভ করেননি । ডক্টর আর কে মুখোপাধ্যায়ের
মতে, সমুদ্রগুপ্ত ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন ।
তার রাজ্যজয়ের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় এলাহাবাদ
প্রশস্তি থেকে । এলাহাবাদ প্রশস্তির দশম থেকে দ্বাদশ স্তবক পর্যন্ত সমুদ্রগুপ্তের বিভিন্ন
রাজ্য বিজয়ের সংবাদ পাওয়া যায় । সমুদ্র গুপ্ত অচ্যুত, নাগসেন, গণপতি নাগ ও কোটা
পরিবারের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন । এরপর তিনি বাকাটকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন
। অনুমান করা হয় যে এই যুদ্ধ মধ্যপ্রদেশের এরাণে হয়েছিল । তিনি এখানে যুদ্ধ জয়ের স্মারক
হিসাবে একটি শিব মন্দির স্থাপন করেন । তিনি মহা ক্ষত্রপ তৃতীয় রুদ্র সেন কে পরাজিত
করেছিলেন । এরপর তিনি গঙ্গা ও দোয়াব অঞ্চলের সমভূমির উপর তাঁর অধিকার সুদৃঢ় করেন ।
দক্ষিণ ভারতের বারো জন রাজা তাঁর গ্রহণ-মোক্ষ-অনুগ্রহ নীতি গ্রহণ করেন ।
সমুদ্র গুপ্ত উত্তর ভারতের নয়জন রাজাকে পরাজিত করে
তাঁদের সাম্রাজ্য তিনি নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন । তিনি ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য
সাধন করে নিজেকে ‘একরাট’ রূপে প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে ভিন্ন নীতি
গ্রহণ করেন । উত্তর ভারতের বিজিত রাজ্যগুলি তিনি সরাসরি তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত
করেন । কিন্তু, দক্ষিণ ভারতে তিনি গ্রহণ-মোক্ষ-অনুগ্রহ নীতি গ্রহণ করেন । পাটলিপুত্র
থেকে দাক্ষিণাত্যে শাসন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না । এর থেকে তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির
পরিচয় পাওয়া যায় । এই নয় জন রাজার পরিচয় থেকে বলা যায় – উত্তর প্রদেশের অধিকাংশ, মধ্যপ্রদেশের
বিশেষ অংশ ও বঙ্গ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
আর্যাবর্ত জয়ের পর সমুদ্র গুপ্ত আটবিক রাজ্যগুলি
জয় করেন । তাঁর দক্ষিণাপথ অভিযানের পথ সুগম করেন । তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতের পাঁচটি
সীমান্ত রাজ্য জয় করেন । সেগুলি হল – সমতট, কামরূপ, নেপাল, দবক ও কর্তৃপুরা । তিনি
উপজাতি রাজ্যগুলি জয় করে নিজে গ্রাস না করে তাদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করেন । পশ্চিমের
নাগগণ ছিলেন আর্যাবর্তের গুপ্তদের প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বী । আবার নাগদের সাথে সেই সময়
বাকাটকদের মৈত্রীর সম্পর্ক ছিল ।
সমুদ্র গুপ্ত দক্ষিণ ভারত অভিযানের মাধ্যমে তাঁর
সাম্রাজ্যের সীমা সম্প্রসারিত করেননি । পল্লব সেনা বাহিনী ধ্বংস করা এই অভিযানের মূল
লক্ষ ছিল । এই অঞ্চলের অপরিমিত সম্পদ তাঁকে প্রলুব্ধ করেছিল । মনে করা হয় যে – তিনি
একবার দক্ষিণ ভারত অভিযান করেন । যদিও, এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি । দক্ষিণ ভারতের
রাজাদের সবাইকে কর দিতে হত । সেই করের সাহায্যে গুপ্ত সম্রাটগণ একটি আড়ম্বরপূর্ণ, মার্জিত
রাজসভা, একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন ।
সমুদ্র গুপ্ত আর্যাবর্তের রাজ্য গুলি জয় করে দুর্গম
দাক্ষিণাত্যে অভিযান পরিচালনা করে তাঁর সামরিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন । উত্তর ভারতের
বিরাট অংশ তিনি প্রত্যক্ষ শাসন করেছেন । শুধুমাত্র দক্ষিণ দিক বাদ দিয়ে বাকি তিন দিক
এই অঞ্চলকে কয়েকটি করদ রাজ্য দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন ।
সমুদ্র গুপ্তের রাজত্বের সূচনা সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও
তাঁর শাসনের সমাপ্তি বিষয়ে ততটা মতভেদ নেই । পরবর্তী সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্র গুপ্তের
প্রথম লেখ ৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে মথুরায় পাওয়া গেছে । এর থেকে জানা যায় যে – ৩৭৫-৩৭৬ খ্রিস্টাব্দে
সমুদ্র গুপ্তের রাজত্ব শেষ হয়েছিল । তিনি শুধু যোদ্ধা বা রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি
মানবিক গুনের অধিকারী ছিলেন । তিনি বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন । শাস্ত্রতত্ত্বে পারদর্শী
ছিলেন, তিনি বহু কবিতা রচনা করেন ।
আবার তিনি সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন । তাঁর বিনা বাদনরত
মুদ্রায় প্রমাণ পাওয়া যায় । তার বীণা বাদনরত মূর্তি দেখে অনুমিত হয় যে তিনি ছিলেন
সংগীত রসিক । ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গৌরব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয় সমুদ্র গুপ্তের আমলে । অনেকে
আবার তাঁকে সম্রাট অশোকের সাথে তুলনা করেছেন । শিল্প মণ্ডিত সুবর্ণ মুদ্রা গুপ্ত যুগের
গৌরব । তিনি সাধারণত ‘পরাক্রম’ উপাধি ও তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে বিক্রম অভিধা গ্রহণ
করেন । ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হলেও সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন পরমতসহিষ্ণু । সমুদ্র গুপ্ত
হিন্দু রাজচক্রবর্তী আদর্শের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ জয়ের শেষে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের
অনুষ্ঠান করেছিলেন । এই যজ্ঞানুষ্ঠানের স্মৃতিকে রক্ষা করার জন্য তিনি ‘অশ্বমেধ পরাক্রম’
এই দুটি শব্দ দিয়ে বিশেষ মুদ্রা প্রচলন করেন ।
গুপ্ত পূর্ব যুগে ও গুপ্ত যুগের প্রথম দিকে ভারতের
সাথে সিংহলের ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্য বিশেষ বৃদ্ধি পেয়েছিল । ভারতের
সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য সিংহল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল । উত্তর ভারতের বৃহত্তম বন্দর
তাম্রলিপ্তের সঙ্গে সিংহলের বিশেষ বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল । ভারতের মসলিন চীনে বিশেষ পরিচিত
ছিল । চীনের রেশম ভারতীয়দের কাছে বিশেষ কদর ছিল । এই বাণিজ্য সমুদ্র গুপ্তের বৈদেশিক
সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছিল ।
আমাদের
লেখা আপনার কেমন লাগছে বা আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার
বন্ধুদের কাছে পোস্ট টি পৌঁছেদিতে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুণ । ইতিহাস বিষয়ে আরও পোস্ট
পড়তে নিচে ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুণ । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
।
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে আপনার প্রয়োজন অনুসারে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
ধন্যবাদ
মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷