সম্রাট অশোকের শাসন ব্যবস্থা, ধর্ম, ইত্যাদি কেমন ছিল ?.
সম্রাট অশোক ছিলেন মৌর্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ।
অশোকের ইতিহাস জানার জন্য আমরা সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের উপর নির্ভরশীল
। সাহিত্য উপাদানের মধ্যে বিদ্যবদান, সিংহলী ইতিবৃত্ত প্রধান । ইতিহাসের উপাদান
হিসাবে এগুলি দুর্বল কারণ- এগুলি সমসাময়িক নয় । সেই তুলনায় অশোকের লেখগুলি বেশি
বিশ্বাসযোগ্য । যেসব ভারতীয় লেখ পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে অশোকের লেখ এদের মধ্যে
প্রাচীনতম । এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য জেমস প্রিন্সেপ সর্ব প্রথম অশোকের লেখ
পাঠোদ্ধার করেন । এই লেখগুলি গিরি গাত্রে, স্তম্ভের উপর, গুহার অভ্যন্তরে পাওয়া
গেছে । ভারতের ইতিহাসে অশোক প্রথম সম্রাট যে তার আদর্শ ও কৃতিত্ব এভাবে লিখে
গিয়েছিলেন ।
খ্রিষ্টপূর্ব
২৭২ সালে বিন্দু সারের মৃত্যুর পর পুত্রদের মধ্যে সিংহাসনের অধিকার নিয়ে বিবাদ
শুরু হচ্ছিল । বিন্দু সারের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম সুধীন, দ্বিতীয় পুত্র অশোক । সুধীন ছিলেন
উদ্ধত বিলাসী । অশোক ছিলেন হৃদয়হীন নিষ্ঠুর প্রকৃতির । ভাইকে হত্যা করে সিংহাসন
অধিকার করলেন । খ্রিস্টপূর্ব ২৬৯ অব্দে অশোকের রাজ্যাভিষেক
উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল । অশোক
সিংহাসনে আরোহণ করে প্রথম কয়েক বছর নিজের অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন । যারা তার
আনুগত্য স্বীকার করতে অস্বীকার করল, তিনি
তাদের নির্মমভাবে হত্যা করলেন ।
অশোক তাঁর রাজত্বের শুরুতে মৌর্যদের
চিরাচরিত রীতি অনুসারে রাজ্য সম্প্রসারণে মন দেন । তিনি তাঁর রাজত্বের ৮ বছরে
খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ অব্দে কলিঙ্গ রাজ্য জয় করেন । সিংহলী ইতিবৃত্তে এই ঘটনার কোন
উল্লেখ পাওয়া জায় না । অশোক কেন কলিঙ্গ রাজ্য জয় করেন তা নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি
বিভিন্ন মন্তব্য দিয়েছেন । তিব্বতীয় বিবরণ থেকে জানা যায় যে – অশোক দক্ষিণ ভারতের
প্রবেশের স্থলপথ ও জলপথ নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন । কলিঙ্গ সেই পথে বাঁধা
হয়েছিল । প্লিনির মতে – কলিঙ্গ নন্দ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল । চন্দ্রগুপ্তের সময় সেটি
স্বাধীন হয়ে যায়, তাই অশোক কলিঙ্গ জয় করতে বাধ্য হন ।
দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনী ছিল শক্তিশালী । কিন্তু
মগধের সৈন্যরা অনেক বেশি যুদ্ধ পটু আর কৌশলী । কলিঙ্গের সৈন্যরা বীর বিক্রমে লড়াই
করেও পরাজিত হল । আহত আর নিহত সৈন্যে ভরে উঠল যুদ্ধক্ষেত্র । এই যুদ্ধে প্রায় ১ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, দেড় লক্ষ মানুষ বন্দি হন
। আরও বিভিন্ন ভাবে অনেক মানুষের মৃত্যু হয় । এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কলিঙ্গ মৌর্য
সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়েছিল । যার রাজধানীর নাম ছিল তোসালী । এই যুদ্ধ
ছিল মৌর্যদের ইতিহাসে শেষ বড় যুদ্ধ । মগধ ও ভারতের ইতিহাসে এক নতুন পথের নির্দেশক
। যুদ্ধক্ষেত্রের এই বিভীষিকাময় দৃশ্য
দেখে সম্রাট বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। অনুভব করলেন তার সমস্ত অন্তর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে ।
এই যুদ্ধের পর অশোক আর কোন যুদ্ধ করেননি । এই
যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণাম অশোকের চরিত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল । রাষ্ট্রীয় ও
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন ।
এত দিন যে রাজসুখ বিলাস ব্যসনের সাথে
পরিচিত ছিলেন তা পরিত্যাগ করে সরল পবিত্র জীবনযাত্রা অবলম্বন করলেন । কলিঙ্গ
যুদ্ধের অল্প কিছুদিন পরেই তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেন । তিনি শপথ করলেন
আর যুদ্ধ নয়, আর হিংসা নয়, ভগবান বুদ্ধের করুণায় আলোয় অহিংসা
মন্ত্রে ভরিয়ে দিতে হবে সমগ্র পৃথিবী । বৌদ্ধ
ধর্মের প্রেম করুণায় পূর্ণ হয়ে উঠল তার হৃদয় । এরপর অহিংসাকে তিনি তাঁর জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন । তাঁর
ধর্মমত পরিবর্তন হয়েছিল । তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন ।
অশোক বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন । বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পর অশোকের ব্যক্তিগত জীবন ও অভ্যাস বিশেষভাবে
পরিবর্তন হয়েছিল । প্রধানত
তারই প্রচেষ্টায় পূর্ব ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করে । শুধু সিংহল নয়, ভারতবর্ষের বাইরে আরও বহু দেশে বৌদ্ধ
ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি লোক পাঠালেন । অশোক বৌদ্ধ হলেও অন্য কোনও ধর্মের প্রতি
তার কোনও বিদ্বেষ ছিল না । শুধু মানুষ নয়, পশুদের
প্রতিও ছিল তার গভীর মমতা । কোন প্রাণী হত্যা করে ‘বলি’ দেওয়ার
প্রথা বন্ধ করেন । শিকার বা জমি পরিষ্কারের জন্য বন পোড়ানো নিষিদ্ধ করেন । তাঁর
মতে – পশু শক্তি দ্বারা জয়লাভ প্রকৃষ্ট নয়, ধর্মের দ্বারা জয়লাভ প্রকৃষ্ট । তিনি
কলিঙ্গ যুদ্ধকে তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধ হিসাবে দেখেছেন । তিনি একটি শিলা লেখতে
ঘোষণা করেন – কেউ যদি ক্ষতি করে তবে তাকে যেন যথাসাধ্য সম্ভব ক্ষমা করে দেওয়া হয় ।
এই ধর্ম বিজয়ের নীতি মৌর্য সাম্রাজ্যের নীতির পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায় । এরফলে মৌর্য
সাম্রাজ্য সামরিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে ।
অশোকের শাসন ব্যবস্থা কয়েকটি মূল নীতির উপর
প্রতিষ্ঠিত ছিল । আইন ও রাজনৈতিক দিক থেকে অশোকের শাসন ব্যবস্থা নিরঙ্কুশ
রাজতন্ত্র ছিল । এই নীতি গুলির অন্যতম কেন্দ্রী করন নীতি । অশোকের শাসন ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে পিতৃত্ব বোধের
উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল । দ্বিতীয় কলিঙ্গ লেখতে তিনি বলেছেন – ‘সকল মানুষ আমার সন্তান’
। এই নৈতিক বোধ তিনি তাঁর সকল কর্মচারীর মধ্যে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন । রাজা তখন
শুধু আইনের রক্ষক ছিলেন না, আইন প্রণেতা ছিলেন । অশোক রাষ্ট্রের আদর্শ সেবক ছিলেন
। তিনি কঠোর পরিশ্রমের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন । সব জায়গায় ও সব সময় তিনি নিজেকে
রাষ্ট্রের কাজে ব্যাপৃত রাখতেন । জনপথ বাসীর অবস্থা প্রত্যক্ষ করাকে তিনি তাঁর
কর্তব্য বলে ঘোষণা করেন ।
অশোক তাঁর সাম্রাজ্যে বিভিন্ন জনকল্যাণ মূলক কাজ
করেন । তিনি চিকিৎসালয় স্থাপন, ছায়াতরু বপন, বাণিজ্য পথ গুলিতে প্রতি যোজন অন্তর
তিনি বিশ্রামাগার তৈরি করেন । এগুলি তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের বাইরেও সম্প্রসারণ করেন
। প্রমোদ করার জন্য রাজাদের বিহার যাত্রার পরিবর্তে তিনি ধম্ম যাত্রার প্রবর্তন
করেন । তিনি তাঁর সাম্রাজ্য প্রদক্ষিণ করতেন । উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারীদের পাঁচ বা
তিন বছর অন্তর রাজ্য প্রদক্ষিণের নির্দেশ দেন । কর্মচারীদের নিয়মিত রাজ্য
প্রদক্ষিণের ফলে যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক সহজ হয়ে যায় । অশোকের নির্দেশে বহু পথ নির্মাণ করা হল
।
এই সমস্ত পথের দুপাশে প্রধানত বট এবং আম গাছ পোঁতা হতো । যাতে মানুষ ছায়ায় পথ
চলতে পারে । বাণিজ্য পথ গুলির ধারে বিশ্রামাগার
তৈরি করার ফলে বাণিজ্যে উন্নতি ঘটে । ভারতের ইতিহাসে তিনি প্রথম সম্রাট যিনি কল্যাণ
রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন । মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত অপরাধীদের দণ্ডাদেশ কার্যকর করার
আগে তিন দিন পূর্ণ বিশ্রামের সুযোগ তিনি দিয়েছিলেন । প্রতি রাজ্যাভিষেক বার্ষিকীতে
তিনি বন্দীদের মুক্তি দিতেন ।
তবুও এই শাসন ব্যবস্থা ছিল অতিমাত্রায়
কেন্দ্রমুখী । এই ব্যবস্থায় কর্মচারীদের আনুগত্য ছিল একান্তভাবে শুধু রাজার প্রতি
। রাজা পরিবর্তন হলে কর্মচারীদের পরিবর্তন হত । বিচার বিভাগ ও কার্যনির্বাহী
বিভাগের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না । সমগ্র নীতি নির্ধারণ করতেন শুধু কেন্দ্র । এই
কেন্দ্রমুখী শাসন ব্যবস্থা অশোকের মৃত্যুর পর মৌর্য সাম্রাজ্যের অবনতির জন্য
অনেকাংশে দায়ী ছিল ।
আমাদের লেখা আপনার
কেমন লাগছে বা আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার
বন্ধুদের কাছে পোস্ট টি পৌঁছেদিতে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুণ । ইতিহাস বিষয়ে আরও
পোস্ট পড়তে নিচে ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুণ । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে
অনেক ধন্যবাদ ।
আমাদের আরও পোস্ট পড়ুন
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
ধন্যবাদ
মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷