প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্ব কি ?.
প্রাচীন ভারতের
ইতিহাসের তেমন কিছু নির্দিষ্ট উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়নি । ঐতিহাসিক ও
প্রত্নতাত্ত্বিকরা নানা উপাদানের টুকরো জুড়ে জুড়ে একটা গোটা ছবি তৈরি করার চেষ্টা
করছেন । তাই প্রাচীন ভারতের চর্চার কাজ কঠিন হলেও অসম্ভব নয় । ঐতিহাসিকরা অক্লান্ত
চেষ্টার দ্বারা ইতিহাসের তথ্য আবিষ্কার ও সংগ্রহের কাজে ব্যাপৃত রয়েছেন । প্রাচীন
ভারতের ইতিহাসের গ্রন্থের অভাবের কারণ কি ছিল, তা নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন
ব্যাখ্যা দিয়েছেন । কেউ বলেন সেগুলি লুপ্ত হয়ে গেছে, আবার কেউ বলে সেই সময় ইতিহাস
লেখার যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না ।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান গুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয় - সাহিত্যিক উপাদান ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান । সাহিত্যিক উপাদানকে আবার ভারতীয় সাহিত্য ও বৈদেশিক সাহিত্য দুটি ভাগ রয়েছে । প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান গুলিকে মুদ্রা, লেখ, স্থাপত্য-ভাস্কর্য ও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হিসাবে ভাগ করা হয়েছে । এখন আমরা জানবো শুধু সাহিত্যিক উপাদান গুলির কথা । প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের পোস্ট লিঙ্ক নিচে দেওয়া হল ।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার জন্য অনেক রকম সাহিত্য
উপাদান পাওয়া যায় । সেই উপাদান গুলিকে দেশি সাহিত্য ও বিদেশি সাহিত্য এই দুটি ভাগে
ভাগ করা হয় । দেশি সাহিত্যকে আবার ধর্ম ভিত্তিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ এই দুটি ভাগে ভাগ
করা হয়েছে । ধর্ম
ভিত্তিক সাহিত্যের মধ্যে প্রধান হল বৈদিক সাহিত্য । খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের আগের ইতিহাস জানতে আমাদের
বহুলাংশে বৈদিক সাহিত্যের উপর নির্ভর করতে হয় । পৃথিবীর
প্রাচীনতম গ্রন্থ হল ঋকবেদ, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বের মধ্যে
এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল । ঋকবেদ থেকে বৈদিক সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, সম্পর্কে বিভিন্ন
তথ্য পাওয়া যায় । সাম, যজু ও অথর্ব বেদ পরবর্তী কালে রচিত হয়েছিল ।
বৈদিক সাহিত্যে চতুর্বেদ ছারাও ব্রাহ্মণ,
আরণ্যক ও উপনিষদকে বোঝানো হয় । ইতিহাসের উপাদান হিসাবে এদের মূল্য কম নয় । বৈদিক সাহিত্যের পর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশীয়
সাহিত্য উপাদান হলো রামায়ণ ও মহাভারত । মহাকাব্য গুলির মধ্যে
রামায়ণ ও মহাভারতের কথা উল্লেখ যোগ্য । কবে এই মহাকাব্য গুলি রচিত হয়েছিল তার সঠিক
সময় জানা যায়না । তবে অনুমান করা হয় যে রামায়ণ আগে রচিত হয়, আর মহাভারত রচিত হয়
তার পরে । রামায়ণ হল মহাভারতের চার ভাগের এক ভাগ । রামায়ণ থেকে বোঝা যায় আর্য সভ্যতা দক্ষিণে সিংহল
পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল । মহাভারত থেকে আর্যদের সভ্যতা ও রাজনৈতিক বিস্তারের কথা
জানা যায় । পুরাণ বলতে বোঝানো হয় প্রাচীন কাহিনী ও ধর্মীয়
অনুশাসনের সংক্ষিপ্ত সার । পুরাণ আছে মোট আঠারটি, তাদের মধ্যে বিখ্যাত মৎস্য,
বায়ু, বিষ্ণু, ভাগবত, ভবিষ্য পুরাণ ।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের নানা লেখাতে প্রাচীন ভারতের
ইতিহাসের অনেক কথা জানা যায় । বৌদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখ্য হল – ‘দীপ বংশ’, ‘মহা
বংশ’, ‘জাতক’ ।
দীপ বংশ ও মহা বংশ হল মৌর্য সম্রাট অশোক ও অন্যান্য ব্যক্তিদের জীবন বৃত্তান্তের
সিংহলী বিবরণ । জাতক হল গৌতম বুদ্ধের পূর্ব জন্ম বিষয়ক লোক কাহিনীর বিবরণ । প্রায় ৫৪৯ টি জাতক কাহিনীর সন্ধান পাওয়া গেছে । জৈন
সাহিত্য ভগবতীসূত্র খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ইতিহাস জানতে সহায়তা করে । ভদ্র
বাহু রচনা করেন জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর কে নিয়ে ‘জৈনকল্পসূত্র’ ।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান আরও অন্যান্য
গ্রন্থ থেকে জানা যায় । তাদের মধ্যে উল্লেখ্য – গার্গী সংহিতা, পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’,
পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ । কালিদাসের
রঘুবংশ থেকে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যজয় সম্পর্কে জানা যায় । বুদ্ধদেবের
জীবনী হিসাবে অশ্বঘোষ রচনা করেন ‘বুদ্ধচরিত’ । হর্ষবর্ধনের জীবনী ভিত্তিক
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল বানভট্রের হর্ষচরিত । চালুক্য বংশীয় রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের সভাকবির রচিত গ্রন্থ ‘বিক্রমাদিত্যে
চরিত’ থেকে রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের কথা জানা যায় । পাল বংশের শাসক রামপাল
সম্পর্কে সন্ধ্যাকর নন্দী রচনা করেন ‘রামচরিত’ । জৈন আচার্য জয় সিংহ চালুক্য রাজা
কুমার পালকে নিয়ে রচনা করেন ‘কুমার পাল চরিত’ ।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের লেখার জন্য তিন ধরণের
বিদেশি বিবরণ পাওয়া যায় । গ্রিক, রোমান ও চিনা পর্যটকদের বিবরণ । ইতিহাসের জনক
হেরোডোডাসের গ্রন্থ ‘Persae’ থেকে
পারসিকদের দ্বারা উত্তর-পশ্চিম ভারত আক্রমণ ও অধিকারের কথা জানা যায় ।
মেগাস্থিনিসের লেখা ‘ইন্ডিকা’ বই থেকে মৌর্য যুগ সম্পর্কে জানা যায় । কোন এক গ্রিক
নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস অফ-দি এরিথ্রিয়ান সী’ এই বইটি থেকে মৌর্য পরবর্তী যুগের
ভারতের অর্থনীতি, বন্দর, পোতাশ্রয়, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি জানা যায় । খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে টলেমী ‘ভূগোল’ গ্রন্থটি রচনা করেন ।
রোমান লেখকদের মধ্যে দুইজন হলেন –
প্লিনি ও কুইনটাস কার্টিয়াস রুফাস । প্রথম শতাব্দীতে প্লিনি প্রকাশ করেন তাঁর
গ্রন্থ ‘Natural History’ । দ্বিতীয় ব্যক্তি আলেকজান্ডারের
ভারতের ইতিহাসের কথা লিখেছেন । চীনা পর্যটকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ফা-হিয়েন ।
তিনি চল্লিশটি অধ্যায়ে তাঁর গ্রন্থ ‘ফো-কুহ-কি’ তে বৌদ্ধরাজ্য গুলির বিবরণ লিখেছেন
। আর একজন বিখ্যাত চীনা পর্যটক ছিলেন হিউয়েন সাং । হর্ষবর্ধনের সময়ে তিনি ভারতে
আসেন । সমগ্র ভারত তিনি পরিদর্শন করেছিলেন । তিনি রচনা করেন ‘সি-ইউ-কি’ । এই গ্রন্থে
তাঁর হর্ষবর্ধনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রমাণিত হয় । সপ্তম শতকের শেষে ভারতে আসেন
ই-সিং, তিনি সেই সময়ের বৌদ্ধ ধর্মের বিবরণ লিখেছেন । তিব্বতের ঐতিহাসিক তারানাথ
রচনা করেন ‘ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের জন্ম’ । এই গ্রন্থটি ৪৪ টি অধ্যায়ে বিভক্ত, ১৬০৮
সালে প্রকাশিত হয় । বৌদ্ধ ধর্ম ও পাল রাজাদের কথা জানার জন্য এই গ্রন্থ মূল্যবান ।
সুলতান মামুদের সময় ভারতে আসেন আল-বিরুনি । তিনি যে গ্রন্থ রচনা করেন তার নাম
‘তাহ-কিক-ই-হিন্দ’, সে সময়ের হিন্দু সমাজ ও ধর্ম ইত্যাদির কথা জানা যায় ।
আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে
তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে
শেয়ার করুন । ইতিহাস বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে
ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুন । পুরো পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক
ধন্যবাদ ।
আমাদের আরও পোস্ট পড়ুন -
কুষাণ সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্য ও অন্যান্য দিক কেমন ছিল ?.প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা ও মহাবিহার গুলি কেমন ছিল ?
হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন দিক কেমন ছিল ?.
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে আপনার প্রয়োজন অনুসারে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।
আপনার লেখনী খুবই সুন্দর ।। অনেক নতুন তথ্যের সন্ধান পেলাম।। ধন্যবাদ।।
উত্তরমুছুনYoutube এ পুরনো কলকাতার ইতিহাস সমন্ধে একটি video পেলাম দেখার অনুরোধ রইল।
https://youtu.be/UicX0dpcvto
ছোট এর মধ্যে খুব ই অসাধারন
উত্তরমুছুন