প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা ও মহাবিহার গুলি কেমন ছিল ?
আমরা
বাংলা ভাষায় কথা বলি । আমদের এই বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার থেকে এসেছে
বলে মনে করা হয় । এমন দেখা যায় যে, বিভিন্ন ভাষার শব্দের মধ্যে
অন্তর্নিহিত মিল রয়েছে । বাংলায় আমরা বলি মা, সংস্কৃতে মাত বা মাতৃ, ইংরেজিতে Mother শব্দের অর্থও মা । এইভাবে বেশকিছু
শব্দের মিল খুঁজে পাওয়া যায় । মানুষের মত ভাষারও পরিবার আছে । এই রকম একটি ভাষা
পরিবার হল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার ।
ইউরোপ ও ভারতীয় উপমহাদেশের
অনেক ভাষা এই ভাষা পরিবারের সদস্য । ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা ব্যবহারকারীরা কোন এলাকায়
বাস করতো সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে । অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন – এরা মধ্য এশিয়ার
তৃণভূমি অঞ্চলে যাযাবর ছিল । খাদ্যের অভাব দেখা দিলে এরা ভারতে, ইরানে, ইউরোপের
বিভিন্ন অঞ্চলে চলে আসে ।
বেদ কথাটি ‘বিদ’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ
জ্ঞান । সমস্ত বৈদিক সাহিত্য চারভাগে বিভক্ত – সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ ।
সংহিতাতে আছে ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব বেদ । ঋক
বেদ হল সবথেকে পুরনো সাহিত্য উপাদান । এরপরের রচনাগুলি পরবর্তী বৈদিক যুগের বলে
ধরা হয় । বৈদিক সাহিত্য ঠিক কোন সময় রচনা করা হয়েছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায়না । আনুমানিক
খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৬০০ অব্দের মধ্যে বৈদিক সাহিত্য রচিত হয় । এরপর
খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত পরবর্তী বৈদিক যুগ ।
বৈদিক যুগে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান ছিলেন গুরু
। শিক্ষা লাভের জন্য তাঁর কাছে ছাত্রদের প্রথমে আবেদন করতে হত । উপযুক্ত হলে
উপনয়নের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গুরু সেই ছাত্রকে শিষ হিসাবে গ্রহণ করতেন । সেই সময়
মৌখিক ভাবে শিক্ষা চর্চা হত । ছাত্রদের গুরুর বোঝানো পাঠ শুনে মুখস্থ করতে হত । প্রাচীন
শিক্ষাব্যবস্থায় স্মৃতির উন্নতি সাধন ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । ছাত্রদের
থাকা, খাওয়ার সমস্ত দায়িত্ব গুরুর উপর ছিল । বেদ পাঠের সঙ্গে ব্যকরন, গণিত, ভাষা
শিক্ষার চর্চা হত ।
বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি ছাত্রদের হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হত । অস্ত্র চালনা, চিকিৎসা করার চর্চা হত । শিক্ষিত মেয়েরা নাচ গানের চর্চা করতেন । প্রায় বার বছর ধরে শিক্ষা দেওয়া হত । শিক্ষা শেষ হলে ‘সমাবর্তন’ নামে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্রকে স্নাতক বলে ঘোষণা করা হত । গুরুর গৃহ থেকে চলে যাওয়ার সময় ছাত্রকে গুরু দক্ষিণা দিতে হত । গুরু দক্ষিণা হিসাবে গরু দান করা হত ।
পরবর্তী বৈদিক যুগের পড়াশোনা প্রথা খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক নাগাদও চালু ছিল । খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের দিকে বেদের পাশাপাশি কাব্য, ব্যকরন, ছন্দ, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, মুদ্রা, নথিপত্র, যুদ্ধ ও শিকার সম্বন্ধে পড়ানো হত । এই সময় জীবিকা ও পড়াশোনার মধ্যে একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল । এর পাশাপাশি বৌদ্ধ বিহারগুলিতে এক নতুন শিক্ষা পদ্ধতি ও লিপির ব্যবহার শুরু হয় । কয়েকটি বিখ্যাত মহাবিহার গুলি হল – নালন্দা, তক্ষশীলা, বিক্রমশীলা, বলভী ইত্যাদি । এই মহাবিহার গুলিতে দেশ বিদেশের ছাত্ররা পড়তে আসতো ।
নালন্দা –
নালন্দা মহাবিহার ছিল গুপ্ত যুগের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্র । প্রাচীন
ভারতের মগধ রাজ্যে(বিহার) এটি অবস্থিত । খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে বারশো
শতাব্দী পর্যন্ত এটি ছিল ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । নালন্দা
বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠার জন্য ৫০০ বণিক ১০ কোটি স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করেন বলে হিউয়েন
সাং এর থেকে উল্লেখ পাওয়া যায় । এখানে যেকোনো ধর্ম, বর্ণের ছাত্ররা পড়তে পারতেন ।
ভর্তি হওয়ার জন্য ছাত্রদের কঠিন পরীক্ষায় পাশ করতে হত । এখানে থাকা, খাওয়া ও
পড়াশোনার জন্য কোনও মূল্য দিতে হতনা । লেখাপড়ার শেষে পরীক্ষা দেওয়া রীতি ছিল । নাগার্জুন নালন্দার অধ্যক্ষও হয়েছিলেন । সেই
সময়ের অনেক বিখ্যাত মানুষ এই মহাবিহারে পড়াশোনা করেছেন । সুমাত্রা, জাভা, তিব্বত,
চীন, কোরিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে ছাত্ররা নালন্দায় পড়তে এসেছিলেন । তুর্কি আক্রমণের
ফলে এই বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয় । এই বিহারে বুদ্ধের
একটি মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল । বর্তমানে নালন্দা একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন
কেন্দ্র এবং বৌদ্ধ তীর্থ পর্যটন পথের অন্যতম গন্তব্যস্থল ।
তক্ষশীলা –
গান্ধার জনপদের রাজধানী ছিল তক্ষশীলা । প্রাচীন তক্ষশীলা শহর ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ
ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র । টলেমির ভূগোলে তক্ষশীলাকে বর্ণনা করা হয়েছে 'তক্ষিয়ালা' (Taxiala) হিসেবে । বর্তমানে এটি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি জেলায় অবস্থিত
। এই স্থান ধীরে ধীরে শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । যোগ্যতার ভিত্তিতে
ছাত্র বাছাই করে নেওয়া হত । সাধারণত ষোলো থেকে কুড়ি বছর বয়সের ছাত্ররা ভর্তি হতেন
। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে বহু ছাত্র এখানে পড়তে আসতেন । রাজা বা ব্যবসায়ি’রা এই
বিদ্যালয় চালানোর জন্য জমি বা অর্থ দান করতেন । এখানকার বিখ্যাত ছাত্ররা হলেন চাণক্য,
জীবক, পাণিনি ।
ফাসিয়ান ও সুয়ান জাং এর লেখার মাধ্যমে জানা যায়
যে – বাংলাতে অনেকগুলি বৌদ্ধ বিহার ছিল । নালন্দার সমসাময়িক একটি বৌদ্ধবিহার ছিল
পশ্চিম মেদিনীপুরের কাছে মোঘলমারিতে । মগধ থেকে তাম্রলিপ্ত যাওয়ার পথে এই বিহারটি
অবস্থিত । সুবর্ণরেখা নদী এই বিহারের কাছ দিয়ে বয়ে যেত । মনে করা হয় এই বিহারটিতে
বনিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । প্রত্নতাত্ত্বিক ডঃ অশোক দত্ত এই বৌদ্ধ বিহারটি
আবিষ্কার করেন । পশ্চিমবঙ্গের বৌদ্ধ
প্রত্নস্থলের মধ্যে এখন এটি হল সবথেকে বড়ো । এই বৌদ্ধ বিহারের নাম কি ছিল তা এখন
জানা যায়নি ।
আমাদের লেখা আপনার
কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নীচে কমেন্ট করে জানান । আপনার
বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন । ইতিহাস বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে
নিচে ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুন । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
আমাদের আরও পোস্ট পড়ুন -
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে আপনার প্রয়োজন অনুসারে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।
এই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।
উত্তরমুছুনLot of thanks for bangla gk information help me
উত্তরমুছুন