গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের অজানা কাহিনী কি ?.
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ
শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিতে বদল
শুরু হয় । আগে সমাজ কাজের ভিত্তিতে শ্রেণি বিভাগ ছিল, পরে তা বদলে গিয়ে
জন্মগত হয়ে যায় । এর ফলে সমাজে জাতিভেদ প্রথা প্রবল দেখা যায় । ধর্মের নামে আচার, অনুষ্ঠান, আড়ম্বর বেড়ে যায়
। সে সময় ব্রাহ্মন্য ধর্ম আড়ম্বর পূর্ণ ও অনুষ্ঠান সর্বস্ব হয়ে ওঠে । চাষের কাজের
জন্য গবাদি পশু প্রয়োজন হত, অথচ যজ্ঞে সেই পশু বলি দেওয়া হত । কৃষকদের কাছে
সেটি মেনে নেওয়া কঠিন ছিল । এই সময় অনেক নতুন নতুন নগর গড়ে ওঠে । অনেক ব্যবসায়ী
প্রচুর ধনী হয়ে ওঠেন । সমাজে ক্ষত্রিয়রা এসময় ব্রাহ্মনদের মত সমান অধিকার দাবি
করেন ।
ব্রাহ্মন্য ধর্মে সমুদ্র যাত্রা, সুদে টাকা ধার দেওয়া পাপ বিষয় বলে
বলা হয় । এরকম বিভিন্ন কারণে বৈদিক ধর্ম থেকে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য
হয় । তাই তারা নতুন ও সহজ সরল ধর্মের দিকে আগ্রহ দেখান । নতুন ধর্ম প্রচারকরা নতুন
নতুন কথা বলে সাধারণ মানুষকে তাঁদের দিকে আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন । সেই চাহিদা পূরণ
করেছিল প্রধান দুটি ধর্ম – বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম । এখন আমরা
বৌদ্ধ ধর্মের কথা জানব ।
বুদ্ধের
জীবন – গৌতম
বুদ্ধের জীবন সম্পর্কে সমসাময়িক ঐতিহাসিক উপাদানের অভাবে আমরা খুব কম তাঁর
সম্পর্কে জানতে পারি । জাতক, সিংহলী
ইতিবৃত্ত, সংস্কৃত
ভাষায় লিখিত গ্রন্থ ললিত বিস্তার ও অশ্ব ঘোষের বুদ্ধ চরিত ইত্যাদি গ্রন্থের
সাহায্যে কিছুটা জানা যায় । গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৬ অব্দে নেপালের
তরাই অঞ্চলে কপিলা বস্তুর শাক্য বংশে । পিতার নাম শুদ্ধোদন, তিনি
ছিলেন কপিলা বস্তুর রাজা । মাতার নাম ছিল মায়া দেবী । বুদ্ধের প্রথমে নাম ছিল
সিদ্ধার্থ । মাসি গৌতমির কাছে মানুষ হয়েছিলেন বলে এর এক নাম হয় গৌতম । কপিলা
বস্তুর কাছে লুম্বিনি শালকুঞ্জে সিদ্ধার্থের জন্ম হয় ।
গনৎকারেরা
গণনা করে বলেছিলেন যে – এই
সন্তান হয় একজন মহান সম্রাট হবে, না
হয় একজন মহান ধর্ম প্রচারক হবে । পিতা শুদ্ধোদনের কাছে এই বানী চিন্তার কারণ হয় ।
তাই তিনি সিদ্ধার্থকে জরা-মৃত্যু প্রভৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে তাঁর সকল প্রকার
বিদ্যার ব্যবস্থা করেছিলেন । প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলেও সিদ্ধার্থের মনে শান্তি
ছিলনা । তিনি পর পর চারটি দৃশ্য দেখেন – জরা, ব্যাধি, মৃত্যু
ও হলুদ পোশাকে এক ধর্মীয় ভিক্ষুক । সিদ্ধার্থের পুত্র রাহুল জন্মানোর কয়েক দিন পর
এক রাত্রিতে ২৯ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেন । তরবারি দিয়ে নিজের চুল কাটেন, সন্ন্যাসীর
পোশাক পরে, শুধুমাত্র
একটি বস্ত্র নিয়ে গৃহত্যাগ করেন । এই ঘটনা ইতিহাসে ‘মহানিস্ক্রমন’ নামে
পরিচিত ।
প্রথমে
তিনি আলার কালাম নামে
এক ব্যক্তির কাছে ধ্যানের পদ্ধতি ও উপনিষদের ব্রহ্ম বিদ্যা শেখেন । এরপর তিনি
পাঁচজন সন্ন্যাসীর সাথে যোগ দিয়ে চরম কৃচ্ছ সাধন করেন । ছয় বছর তিনি এদের সাথে
কাটান । যখন তাঁর ৩৫ বছর বয়স তখন তিনি গয়ার কাছে একটি পিপল বা বট গাছের তলায় বসে
সাধনা করেন । এইভাবে একটানা ৪৯ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন ।
এরপর তাঁর নাম হয় বুদ্ধ ।
এরপর
তিনি তাঁর জ্ঞান প্রচার করার জন্য বারানসির কাছে সারনাথে আসেন । প্রথম তিনি পাঁচ
জন মানুষের কাছে তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন । এই ঘটনাকে বলা হয় ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন’ । তারপরে তিনি রাজ গৃহে
আসেন, সেখানে
বিম্বিসার, শারিপুত্র
প্রভৃতি ব্যক্তি এই ধর্ম গ্রহণ করেন ।
প্রতি
বছর আটমাস বিভিন্ন স্থানে ধর্ম প্রচার করতেন ও বাকি চার মাস গৃহী শিষ্যদের বাড়িতে
কাটাতেন । পরবর্তীকালে সেই সব স্থান বৌদ্ধ বিহারে পরিণত হয় । কোশল রাজ্যে তিনি
একটানা একুশ বছর কাটিয়েছিলেন । তিনি তাঁর বেশির ভাগ ধর্মীয় কাজ এখানে করেন । গৌতম
বুদ্ধ প্রায় ৪৫ বছর ধর্ম প্রচার করেছিলেন । ৮০ বছর বয়সে আনুমানিক ৪৮৬
খ্রিস্টপূর্বে কুশিনগরে তিনি দেহত্যাগ করেন । খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে
বাংলায় পাল যুগের শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার হয় । সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মকে
বিশ্বধর্মে পরিণত করেন । এখনও চীন, কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোচিন
প্রভৃতি দেশে বৌদ্ধ ধর্মের মানুষ বসবাস করে ।
গৌতম
বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের মানব জীবনে দুঃখের কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন । এই দুঃখ থেকে
মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি চারটি উপদেশ প্রদান করেন – ১)
জীবন দুঃখময়, ২)
কামনা, বাসনা
ইত্যাদি দুঃখের কারণ, ৩)
কামনা, বাসনার
অবসান ঘটানো সম্ভব, ৪)
এর জন্য নির্দিষ্ট পথ বা মার্গ অবলম্বন করতে হবে । এই চারটি উপদেশকে আর্যসত্য বলা
হয় । তিনি আটটি মার্গ বা পথের কথা বলেছিলেন, এগুলি হল – সৎবাক্য, সৎকাজ, সৎজীবিকা, সৎচেষ্টা, সৎচিন্তা, সৎসচেতনতা, সৎসংকল্প, এবং
সৎদৃষ্টি ।
বৌদ্ধ
ধর্মে পশুর প্রতি অহিংস আচরণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় । লোহা ও লাঙলের ব্যবহারের
ফলে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যে
ও নগরের উন্নতি হয় । ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি ধনশালী হয়ে ওঠে । কৃষি ও বাণিজ্যের ফলে
সমাজে ধন-বৈষম্য ও দারিদ্র দুই বৃদ্ধি পায় । গৌতম বুদ্ধ এর প্রতিবাদের চিন্তা করেন
। নিম্নতম শ্রেণীর মানুষ তাই বেশি করে এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় ।
নগর
গড়ে ওঠার সাথে সাথে নগরে এক ধরনের পরিত্যক্ত নারীর সৃষ্টি হয় । গৌতম বুদ্ধের
দৃষ্টি এদের প্রতি অনেক মানবিক ছিল । তিনি বারবনিতা আম্রপালিকে সন্মানের আসন
দিয়েছিলেন । সংঘে নারীদের প্রবেশিকার দিয়ে তিনি এই ধর্মকে সর্বজনীন করেন । তিনি
সন্ন্যাসিনীদের জন্য একটি পৃথক সম্প্রদায় স্থাপন করেন । সমাজের নিচু স্তরের
মানুষকেও তিনি যথেষ্ট মর্যাদা প্রদান করেন ।
তিনি
জাতিভেদ প্রথা দূর করতে না পারলেও তা কম করতে সক্ষম হয়েছিলেন । সমাজে ব্রাহ্মনদের
বিশেষ স্থান থাকলেও তাঁদের সর্বময় প্রাধান্য তিনি মানতে পারেননি । বৌদ্ধ ধর্ম
অনেকাংশে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে একটি সঠিক ও সাধারণ জীবনযাপন প্রণালী
প্রস্তুত করে । তিনি অধিক ভোগ বিলাস বা সর্বত্যাগ এর কোনটা গ্রহণ করেননি । তিনি
মধ্য পথ অবলম্বন করেছিলেন । এই পথ প্রকৃতপক্ষে একটি নৈতিক বিধান । মধ্য পথ বৌদ্ধ
ধর্মকে অন্যান্য ধর্মের থেকে বেশি আকর্ষণীয় করেছিল ।
বৌদ্ধ
ধর্মে চারটি বৌদ্ধ সম্মেলনের গুরুত্ব রয়েছে । প্রথম বৌদ্ধ সম্মেলনে সুত্ত ও বিনয়
পিটক সংকলন করা হয় । দ্বিতীয় বৌদ্ধ সম্মেলনে বৌদ্ধরা থেরবাদী ও মহাসাংঘিক এই দুই
ভাগে ভাগ হয়ে যায় । তৃতীয় বৌদ্ধ
সম্মেলনে সংঘের মধ্যে ভাঙন আটকানোর চেষ্টা করা হয় । বৌদ্ধ ধর্মের নিয়ম গুলি
কঠোরভাবে পালনে জোর দেওয়া হয় । চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলনের বৌদ্ধরা হীনযান ও মহাযান
দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় ।
বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম
অবদান ছিল বৌদ্ধ বিহার । বিহার গুলি সমাজের ধনীদের সাহায্যের উপর নির্ভর করে তৈরি
হলেও ধীরে ধীরে এগুলি বৃহৎ বিদ্যা চর্চার কেন্দ্র হিসাবে পরিণত হয় । উল্লেখযোগ্য
বৌদ্ধ বিহার গুলি হল - বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরি, সোমপুরি, নালন্দা
ইত্যাদি ।
আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নীচে
কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন ।
ইতিহাস ও জীবনী বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে ইতিহাস ও জীবনী লেখাটির উপর ক্লিক করুন
। পুরো পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
খুবই ভালো তত্ত্ব উপস্থাপনা
উত্তরমুছুনপ্লিজ পিডিএফ দিন
উত্তরমুছুন