রবিবার, ২১ জুলাই, ২০১৯

কুষাণ সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্য ও অন্যান্য দিক কেমন ছিল ?.


  ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্য পতনের পর কুষাণরা একটি বড়ো সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল । উত্তর ভারতের বেশিরভাগ অংশ কুষাণদের শাসনে এসেছিল । রাজনৈতিক দিক থেকে কুষাণদের সাফল্য ছিল উল্লেখযোগ্য । কুষাণ সম্রাটগণ ভারত ও চিনের মধ্যে যোগসূত্র ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন । উত্তর ভারতে বিভিন্ন শক্তি যেমন – ইন্দো-গ্রীক, ইন্দো-শক, ইন্দো-পার্থিয়গণের যুদ্ধের ফলে বিধ্বস্ত হয় । কুষাণরা অঞ্চলটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনাধীনে এনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন । ইউ.চি উপজাতিদের ঐক্যবদ্ধ করে ।


  কুষাণদের কথা আমরা জানতে পারি ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত মুদ্রা, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও রাশিয়ায় পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক লেখ থেকে । এছাড়া বিভিন্ন গ্রন্থ যেমন - বারদেসানেসের বুক অফ দি লজ অফ কান্ট্রিজ, টলেমীর ভূগোল, কল্পনামণ্ডটীকা, অঙ্গবিজ্জ, আর্মেনীয় ও সংস্কৃত গ্রন্থ । এগুলি ছাড়া স্থাপত্য ও ভাস্কর্য কুষাণ সাম্রাজ্যের ইতিহাস লেখার সাহায্য করে । এইসব উপাদান থেকে পাওয়া তথ্য থেকে আমারা কুষাণদের সম্পর্কে ধারণা করতে পারি ।


  কুষাণদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দেখা যায় যে কুষাণ সম্রাটগণ রাজাতিরাজ, দেব পুত্র ইত্যাদি অভিধা গ্রহণ করতেন । কুষাণ সম্রাটগণ যে দৈব অধিকারের নীতিতে বিশ্বাসী তার প্রমাণ দেবপুত্রঅভিধার মধ্যে পাওয়া যায় । ডঃ বি.এন মুখোপাধ্যায়ের মতে কুষাণ সাম্রাজ্য তিনটি শ্রেণী অঞ্চল ছিল । প্রথম শ্রেণীভুক্ত অঞ্চল ছিল ক্ষত্রপ ও মহাক্ষত্রপ শাসিত এলাকা । চস্টনের পরিবার কিছুদিন কুষাণ সাম্রাজ্যের অনুগত ছিল । তাঁরা যে অঞ্চল শাসন করতো সেটি দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত বলা হয় । পাটলিপুত্র ও পূর্বাঞ্চলের করদ রাজ্যগুলি বা সামন্ত রাজ্যগুলি তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল । সাম্রাজ্যের যে সব অঞ্চলগুলি সম্রাটের প্রত্যক্ষ শাসনে থাকত সেখানে আমলাগণ মহাক্ষত্রপদের মত ভূমিকা পালন করেন । মহাক্ষত্রপদের সামরিক ও বেসামরিক উভয় ধরণের দায়িত্ব পালন করতে হত । রাজ কর্মচারীদের মধ্যে যে স্তরভেদ ছিল তা বোঝা যায় মহাক্ষত্রপ, ক্ষত্রপ, মহা দণ্ডনায়ক, দণ্ডনায়ক ইত্যাদি দেখে ।

  অর্থনৈতিক দিক থেকে কুষাণ যুগ উন্নত ছিল । এর কারণ হিসাবে বলা যায় প্রচুর শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার হয়েছিল । এ যুগে স্বর্ণমুদ্রা, মনি মুক্ত, শিরোভূষণের জন্য দামি পাথর পাওয়া গেছে ।  এর থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে সেই সময় শিল্পে ও বাণিজ্যে কতটা উন্নতি হয়েছিল । অনেক নগর ও বাণিজ্য কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল । ভারত, রোম ও চীনের মধ্যে এই সময় ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল । কিছু মুষ্টিমেয় বনিক শ্রেণীর হাতে সেই বাণিজ্যের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয় । ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর মানুষরা সেই সম্পদ ব্যবহার করতো ।

  কৃষিকে একেবারে অবহেলা করা হয়নি । কুষাণ যুগে জলসেচের চিহ্ন পাকিস্তান ও সোভিয়েতের মধ্যে এশিয়া এলাকাতে পাওয়া গেছে । সাধারণ মানুষের দুর্দশা কম ছিল না । মথুরা প্রস্তর লেখ থেকে জানা যায় যে ব্রাহ্মনদের ও মথুরার দুঃস্থ মানুষদের আহার দান করা হত । ধনী অভিজাতরা বহু ক্রীতদাস নিযুক্ত করতেন । কুষাণদের সাথে যে রোমের ব্যবসা বাণিজ্য হত তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁদের মুদ্রার সাহায্যে ।


  কুষাণ যুগে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের উন্নতি হয়েছিল । তা গুপ্ত যুগে পূর্ণতা পায় । অশ্ব ঘোষের রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল বুদ্ধ চরিতএছাড়া সৌন্দ্রানন্দ, সারিপুত্র প্রকরণ তিনি রচনা করেন । তিনি শুধু সাহিত্যে নয় ধর্ম ও দর্শনে নতুন ভাবধারা প্রবর্তন করেছিলেন । সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম নাট্যকার বলা হয় অশ্ব ঘোষকে  অশ্ব ঘোষের সমসাময়িক আরেক জন ব্যক্তি ছিলেন মাতৃচেত । বৌদ্ধ লেখকদের মধ্যে আর এক জন হলেন নাগার্জুন । তিনি ছিলেন দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক ।  কুষাণদের সাথে তাঁর কোনও সম্পর্ক ছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায়না, দক্ষিণের সাতবাহন রাজ্যে তাঁর কর্মস্থল ছিল । ভেষজ বিজ্ঞানে এসময় উন্নত হয়েছিল । চরক ও সুশ্রুতের নাম উল্লেখযোগ্য, যদিও এদের সঠিক সময় জানা যায় না ।

 কুষাণ সম্রাটগণ শিল্প, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন । এরফলে শিল্প, সাহিত্যের ও বিজ্ঞানের উন্নতি হয় । শিল্পের মধ্যে স্থাপত্য ও ভাস্কর্য প্রধান ছিল । সেগুলি প্রধানত মন্দির ও বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল । কুষাণরা অনেক চৈত্য, নগর, মন্দির, বিহার, স্তূপ গড়ে তুলেছিলেন । সুরখ কোটালে খননকার্যের ফলে পশ্চিম বিভাগে মন্দির স্থাপত্য, তক্ষশীলায় ধর্মরাজিক বিহার নির্মাণ ও একটি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের কথা জানা যায় ।

  কুষাণ যুগের প্রধান শিল্পরীতি ছিল গান্ধার  শিল্পরীতি । বুদ্ধের জীবন ভিত্তিক শিল্পের সঙ্গে গ্রীস, রোম ও মধ্য এশিয়ার প্রভাব পড়েছিল । এই সময়ের মূর্তি গুলির উপর গ্রীক দেবতা অ্যাপেলোর প্রভাব দেখা যায় । এই সময়ের আরও একটি মৌলিক শিল্পরীতি হল মথুরা শিল্পরীতি । কুষাণ নৃপতিদের মূর্তি ও বিহার, মন্দিরের ধনী ব্যক্তির মূর্তি এই শিল্পে দেখা যায়  অমরাবতী অঞ্চলে আরও একটি উল্লেখযোগ্য শিল্পরীতি গড়ে উঠেছিল ।


  কুষাণ যুগে বৌদ্ধ ধর্ম ছিল সবথেকে জনপ্রিয় । এই সময় মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম জন্মলাভ করে । বৌদ্ধদের মধ্যে সর্বাস্তিবাদী সম্প্রদায় সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিল । ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পরিবর্তন আসে । শৈব ধর্ম এসময়ও জনপ্রিয় ছিল । প্রথম কণিষ্ক, বাসিষ্ক, হুবিস্কের মুদ্রায় শিবের মূর্তি পাওয়া গেছে । কুষাণ সাম্রাজ্যের মথুরা অঞ্চলে বেশিরভাগ জৈনরা বাস করতেন । এই সাম্রাজ্যের পশ্চিম অঞ্চলে গ্রীক ও ইরানীয় দেব-দেবীর কথা জানা যায় । দেব-দেবীর বিভিন্নতা দুই দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ । এক হল তাঁরা বিভিন্ন ধর্ম রাজনৈতিক সুবিধার জন্য প্রশ্রয় দেন, দুই হল রাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পরিচয় দেয় ।

  ভারত ও চীনের মধ্যে তীর্থযাত্রীরা যাতায়াত করতেন, সেই তীর্থযাত্রীদের আশ্রয়ের জন্য তীর্থ পথে মঠ নির্মিত হয় । চীনে এসময় বৌদ্ধ ধর্ম ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় । কুষাণরা বিভিন্নভাবে পারসিক ও গ্রীকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । তার প্রমাণ হিসাবে ভাষা, ধর্ম, পোশাক, দেব-দেবীত্বে গ্রীক ও পারসিক প্রভাব দেখা যায় ।

  কুষাণ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পরবর্তী সময়ের উপর প্রভাব ফেলে । ভারতে পরবর্তী সময়ে মহাদন্ডনায়ক, অশ্বারোহী সৈন্য, মুদ্রা ও অন্যান্য বিষয়ে অনুসরণ করেছিল । কুষাণ যুগের মুদ্রার প্রভাব উত্তর ভারতে, গুপ্ত যুগে ও অন্যান্য অঞ্চলে প্রভাব দেখা যায় । কুষাণ যুগ ছিল গুপ্ত যুগের ভাস্কর্য ও তুর্কিস্তানের শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা ।


আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোনও প্রশ্ন থাকে তবে নীচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন । ইতিহাস বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুন ।

আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে আপনার প্রয়োজন অনুসারে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ধন্যবাদ

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷