কুষাণ সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্য ও অন্যান্য দিক কেমন ছিল ?.
ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্য পতনের পর কুষাণরা একটি
বড়ো সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল । উত্তর ভারতের বেশিরভাগ অংশ কুষাণদের শাসনে এসেছিল ।
রাজনৈতিক দিক থেকে কুষাণদের সাফল্য ছিল উল্লেখযোগ্য । কুষাণ সম্রাটগণ ভারত ও চিনের
মধ্যে যোগসূত্র ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন । উত্তর ভারতে বিভিন্ন
শক্তি যেমন – ইন্দো-গ্রীক, ইন্দো-শক, ইন্দো-পার্থিয়গণের যুদ্ধের ফলে বিধ্বস্ত হয় ।
কুষাণরা অঞ্চলটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনাধীনে এনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন । ইউ.চি
উপজাতিদের ঐক্যবদ্ধ করে ।
কুষাণদের কথা আমরা জানতে পারি ভারতের
বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত মুদ্রা, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও রাশিয়ায় পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক লেখ
থেকে । এছাড়া বিভিন্ন গ্রন্থ যেমন - বারদেসানেসের ‘বুক অফ দি লজ অফ কান্ট্রিজ, টলেমীর ভূগোল, কল্পনামণ্ডটীকা, অঙ্গবিজ্জ, আর্মেনীয় ও সংস্কৃত গ্রন্থ । এগুলি ছাড়া
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য কুষাণ সাম্রাজ্যের ইতিহাস লেখার সাহায্য করে । এইসব উপাদান থেকে পাওয়া তথ্য থেকে
আমারা কুষাণদের সম্পর্কে ধারণা করতে পারি ।
কুষাণদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দেখা যায় যে
কুষাণ সম্রাটগণ রাজাতিরাজ, দেব পুত্র ইত্যাদি অভিধা গ্রহণ করতেন । কুষাণ সম্রাটগণ যে দৈব
অধিকারের নীতিতে বিশ্বাসী তার প্রমাণ ‘দেবপুত্র’ অভিধার মধ্যে পাওয়া যায় । ডঃ বি.এন
মুখোপাধ্যায়ের মতে কুষাণ সাম্রাজ্য তিনটি শ্রেণী অঞ্চল ছিল । প্রথম শ্রেণীভুক্ত
অঞ্চল ছিল ক্ষত্রপ ও মহাক্ষত্রপ শাসিত এলাকা । চস্টনের পরিবার কিছুদিন কুষাণ
সাম্রাজ্যের অনুগত ছিল । তাঁরা যে অঞ্চল শাসন করতো সেটি দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত বলা
হয় । পাটলিপুত্র ও পূর্বাঞ্চলের করদ রাজ্যগুলি বা সামন্ত রাজ্যগুলি তৃতীয় শ্রেণীর
অন্তর্ভুক্ত ছিল । সাম্রাজ্যের যে সব অঞ্চলগুলি সম্রাটের প্রত্যক্ষ শাসনে থাকত
সেখানে আমলাগণ মহাক্ষত্রপদের মত ভূমিকা পালন করেন । মহাক্ষত্রপদের সামরিক ও
বেসামরিক উভয় ধরণের দায়িত্ব পালন করতে হত । রাজ কর্মচারীদের মধ্যে যে স্তরভেদ ছিল
তা বোঝা যায় মহাক্ষত্রপ, ক্ষত্রপ, মহা দণ্ডনায়ক, দণ্ডনায়ক ইত্যাদি দেখে ।
অর্থনৈতিক দিক থেকে কুষাণ যুগ উন্নত ছিল ।
এর কারণ হিসাবে বলা যায় প্রচুর শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার হয়েছিল । এ যুগে
স্বর্ণমুদ্রা, মনি মুক্ত, শিরোভূষণের জন্য দামি পাথর পাওয়া গেছে । এর থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে সেই সময়
শিল্পে ও বাণিজ্যে কতটা উন্নতি হয়েছিল । অনেক নগর ও বাণিজ্য কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল ।
ভারত, রোম ও চীনের মধ্যে এই সময় ব্যবসায়িক সম্পর্ক
তৈরি হয়েছিল । কিছু মুষ্টিমেয় বনিক শ্রেণীর হাতে সেই বাণিজ্যের সম্পদ কেন্দ্রীভূত
হয় । ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর মানুষরা সেই সম্পদ ব্যবহার করতো ।
কৃষিকে একেবারে অবহেলা করা হয়নি । কুষাণ
যুগে জলসেচের চিহ্ন পাকিস্তান ও সোভিয়েতের মধ্যে এশিয়া এলাকাতে পাওয়া গেছে ।
সাধারণ মানুষের দুর্দশা কম ছিল না । মথুরা প্রস্তর লেখ থেকে জানা যায় যে ব্রাহ্মনদের
ও মথুরার দুঃস্থ মানুষদের আহার দান করা হত । ধনী অভিজাতরা বহু ক্রীতদাস নিযুক্ত
করতেন । কুষাণদের সাথে যে রোমের ব্যবসা বাণিজ্য হত তার প্রমাণ পাওয়া
যায় তাঁদের মুদ্রার সাহায্যে ।
কুষাণ যুগে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের উন্নতি
হয়েছিল । তা গুপ্ত যুগে পূর্ণতা পায় । অশ্ব ঘোষের রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘বুদ্ধ চরিত’ এছাড়া সৌন্দ্রানন্দ, সারিপুত্র প্রকরণ তিনি রচনা করেন । তিনি শুধু সাহিত্যে নয় ধর্ম ও দর্শনে নতুন
ভাবধারা প্রবর্তন করেছিলেন । সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম নাট্যকার বলা হয় অশ্ব ঘোষকে । অশ্ব ঘোষের সমসাময়িক আরেক জন ব্যক্তি ছিলেন
মাতৃচেত । বৌদ্ধ লেখকদের মধ্যে আর এক জন হলেন নাগার্জুন । তিনি ছিলেন দার্শনিক ও
বৈজ্ঞানিক । কুষাণদের সাথে তাঁর কোনও সম্পর্ক ছিল এমন
প্রমাণ পাওয়া যায়না, দক্ষিণের সাতবাহন রাজ্যে তাঁর কর্মস্থল ছিল । ভেষজ বিজ্ঞানে
এসময় উন্নত হয়েছিল । চরক ও সুশ্রুতের নাম উল্লেখযোগ্য, যদিও এদের সঠিক সময় জানা যায় না ।
কুষাণ সম্রাটগণ শিল্প, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন । এরফলে শিল্প, সাহিত্যের ও বিজ্ঞানের উন্নতি হয় । শিল্পের
মধ্যে স্থাপত্য ও ভাস্কর্য প্রধান ছিল । সেগুলি প্রধানত মন্দির ও বৌদ্ধ বিহারকে
কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল । কুষাণরা অনেক চৈত্য, নগর, মন্দির, বিহার, স্তূপ গড়ে তুলেছিলেন । সুরখ কোটালে
খননকার্যের ফলে পশ্চিম বিভাগে মন্দির স্থাপত্য, তক্ষশীলায় ধর্মরাজিক বিহার নির্মাণ ও একটি
বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের কথা জানা যায় ।
কুষাণ যুগের প্রধান শিল্পরীতি ছিল গান্ধার শিল্পরীতি । বুদ্ধের জীবন ভিত্তিক শিল্পের
সঙ্গে গ্রীস, রোম ও মধ্য এশিয়ার প্রভাব পড়েছিল । এই সময়ের
মূর্তি গুলির উপর গ্রীক দেবতা অ্যাপেলোর প্রভাব দেখা যায় । এই সময়ের আরও একটি
মৌলিক শিল্পরীতি হল মথুরা শিল্পরীতি । কুষাণ নৃপতিদের মূর্তি ও বিহার, মন্দিরের ধনী ব্যক্তির মূর্তি এই শিল্পে
দেখা যায় । অমরাবতী অঞ্চলে আরও একটি উল্লেখযোগ্য
শিল্পরীতি গড়ে উঠেছিল ।
কুষাণ যুগে বৌদ্ধ ধর্ম ছিল সবথেকে জনপ্রিয় ।
এই সময় মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম জন্মলাভ করে । বৌদ্ধদের মধ্যে সর্বাস্তিবাদী সম্প্রদায়
সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিল । ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পরিবর্তন আসে । শৈব ধর্ম এসময়ও
জনপ্রিয় ছিল । প্রথম কণিষ্ক, বাসিষ্ক, হুবিস্কের মুদ্রায় শিবের
মূর্তি পাওয়া গেছে । কুষাণ সাম্রাজ্যের মথুরা অঞ্চলে বেশিরভাগ
জৈনরা বাস করতেন । এই সাম্রাজ্যের পশ্চিম অঞ্চলে গ্রীক ও ইরানীয় দেব-দেবীর কথা
জানা যায় । দেব-দেবীর বিভিন্নতা দুই দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ । এক হল তাঁরা বিভিন্ন
ধর্ম রাজনৈতিক সুবিধার জন্য প্রশ্রয় দেন, দুই হল রাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের
পরিচয় দেয় ।
ভারত ও চীনের মধ্যে তীর্থযাত্রীরা যাতায়াত
করতেন, সেই তীর্থযাত্রীদের আশ্রয়ের জন্য তীর্থ পথে
মঠ নির্মিত হয় । চীনে এসময় বৌদ্ধ ধর্ম ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় । কুষাণরা
বিভিন্নভাবে পারসিক ও গ্রীকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । তার প্রমাণ হিসাবে ভাষা, ধর্ম, পোশাক, দেব-দেবীত্বে গ্রীক ও পারসিক প্রভাব দেখা
যায় ।
কুষাণ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ঐতিহ্য ও
সংস্কৃতি পরবর্তী সময়ের উপর প্রভাব ফেলে । ভারতে পরবর্তী সময়ে মহাদন্ডনায়ক, অশ্বারোহী সৈন্য, মুদ্রা ও অন্যান্য বিষয়ে অনুসরণ করেছিল ।
কুষাণ যুগের মুদ্রার প্রভাব উত্তর ভারতে, গুপ্ত যুগে ও অন্যান্য অঞ্চলে প্রভাব দেখা
যায় । কুষাণ যুগ ছিল গুপ্ত যুগের ভাস্কর্য ও তুর্কিস্তানের শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা
।
আমাদের
লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোনও প্রশ্ন থাকে তবে নীচে কমেন্ট করে জানান ।
আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন । ইতিহাস বিষয়ে আরও
পোস্ট পড়তে নিচে ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুন ।
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে আপনার প্রয়োজন অনুসারে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
ধন্যবাদ
মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷