মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০১৯

বাংলায় পাল ও সেন যুগের শাসন ব্যবস্থা, সমাজ ও সংস্কৃতি কেমন ছিল ?.


   বাংলায় প্রথম স্বাধীন উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন রাজা শশাঙ্ক । তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার ইতিহাস পরিবর্তনের কারণে ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বনিক ও সম্ভ্রান্ত লোকেরা নিজের ইচ্ছামত এলাকা শাসন করতে শুরু করেন । সেই সময় বাংলায় কোন কেন্দ্রীয় শাসন ছিলনা । তারফলে শক্তিশালী লোকের দ্বারা দুর্বল লোকেরা অত্যাচারিত হতে লাগল । এই অচলাবস্থাকে মাৎস্যন্যায় বলা হয় । বছরের পর বছর এই অবস্থা চলার পর বাংলার প্রভাবশালী লোকেরা গোপালকে (৭৫০ খ্রিস্টাব্দে) রাজা হিসাবে নির্বাচন করেন । এরপর বাংলায় পাল বংশের রাজত্ব শুরু হয় ।


  পাল রাজাদের আদি নিবাস ছিল সম্ভবত বরেন্দ্র এলাকাতে । শাসনের প্রথম একশো বছর পাল রাজারা তাঁদের ক্ষমতা বিস্তার ঘটায় । এরপর প্রায় একশো ত্রিশ বছর তাঁদের ক্ষমতা কমে যেতে থাকে । দশম শতকের শেষের দিক থেকে পালদের ক্ষমতা আবার অনেক বৃদ্ধি পায় । গোপাল (৭৫০-৭৪ খ্রিস্টাব্দ) বাংলার অধিকাংশ এলাকা নিজের দখলে নিয়ে আসেন । উত্তরের কনৌজ দখলের জন্য তিনি ত্রিশক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন । ধর্মপালের ছেলে দেবপাল (৮০৬-৪৫ খ্রিস্টাব্দ) সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন । উত্তরের হিমালয়ের পাদদেশ, দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত, উত্তর-পশ্চিমে কাম্বোজ দেশ, পূর্বে প্রাগজ্যোতিষপুর পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন ।


  পালদের নিজেদের মধ্যে গোলমালের জন্য দেবপালের পরে পালদের ক্ষমতা কমে যায় । এছাড়া দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকূট, পশ্চিম ভারতের প্রতিহার, ওড়িশার শাসকরা বাংলা ও বিহারের অনেক এলাকা জয় করে নেন । তখন পালদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে মগধ অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পরে । প্রথম মহীপাল (৯৭৭-১০২৭ খ্রিস্টাব্দ) পালদের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন ।  এরপর রামপাল (১০৭২-১১২৬ খ্রিস্টাব্দ) রাজা হন । বরেন্দ্র অঞ্চল কৈবর্ত বিদ্রোহের ফলে পালদের হাতছাড়া হলে রামপাল উদ্ধার করেন । রামপালের মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যে পাল রাজত্ব শেষ পর্যায়ে চলে আসে ।

  বাংলায় পালদের শাসনের পরের কাছাকাছি সময়ে সেনরা শাসক হন । সেনদের আদি বাসস্থান ছিল দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট অঞ্চলে । সামন্ত সেন একাদশ শতকে কোন এক সময় কর্ণাট ছেড়ে রাঢ় অঞ্চলে চলে আসেন । সামন্ত সেন ও তাঁর ছেলে হেমন্ত সেনের সময় রাঢ় অঞ্চলে সেনরা কিছুটা আধিপত্য তৈরি করেছিল । বিজয় সেন (আনু ১০৯৬-১১৫৯ খ্রিস্টাব্দ) গৌড়, মিথিলা, রাঢ়, পূর্ববঙ্গ ইত্যাদি জয় করে রাজ্যের পরিধি বাড়ান । বল্লালসেন (১১৫৯-৭৯ খ্রিস্টাব্দ) পালরাজা গোবিন্দ পালকে পরাজিত করেন । তিনি সমাজ সংস্কার করে গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য আচার-আচরণ প্রতিষ্ঠা করেন, সমাজকে রক্ষণশীল করেন । সাহিত্য, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল । বল্লালসেনের বেদ ও স্মৃতিশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান ছিল ।

  বল্লালসেনের ছেলে লক্ষণ সেন (সম্ভবত ১১৭৯-১২০৪/৫ খ্রিস্টাব্দ)  বারানসী, গৌড়, কামরূপ, ও পুরীতে তাঁর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন । লক্ষণ সেনের রাজধানী ছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে লক্ষণাবতী । লক্ষণ সেনের আমলে বাংলায় তুর্কি আক্রমণ ঘটে । লক্ষণ সেনের মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন দক্ষিণ বঙ্গ ও পূর্ব বঙ্গ কিছুদিন শাসন করেছিলেন । এঁদের পরবর্তী সেন রাজাদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়না ।

 বাংলার ইতিহাসে পাল ও সেন যুগ নিজের বৈশিষ্ট্যের জন্য উজ্জ্বল হয়ে আছে । বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিকে এই শাসকদের বিশেষ প্রভাব পড়েছিল । বাংলার সমাজ জীবনে বর্ণবিন্যাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । বর্ণবিন্যাসের কেন্দ্রে ছিলেন ব্রাহ্মণগণ । ব্রাহ্মণদের পরে সমাজে ছিল করণ-কায়স্থদের জায়গা । পালযুগে কৈবর্ত গোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায় । তাঁরা ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী ছিল । সমাজের নিচুস্তরে চণ্ডাল, ডোম, মেদ, শবর ইত্যাদি জাতি ছিল । সেন রাজাগণ কঠোর বর্ণবিন্যাস গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন । ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্য বর্ণকে সংকর ও শূদ্র বলে মনে করা হত । তারফলে ব্রাহ্মণগণ সমাজের অন্যান্য শ্রেণি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । ব্রাহ্মণরা শূদ্রদের একাংশকে স্লেচ্ছ বা অস্পৃশ্য বলে ঘোষণা করে ।

  পালযুগে বাংলা ভাষার উৎপত্তির সময় ছিল । আনুমানিক ৮০০-১১০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মাগধী অপভ্রংশ ভাষার গৌড় বঙ্গীয় রূপ থেকে ক্রমে ক্রমে প্রাচীন বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয় । সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, ব্যাকরণ, চিকিৎসাশাস্ত্র ইত্যাদিতে তখন প্রধানত সংস্কৃত ভাষাতেই রচনা করা হত । ঐ ভাষা সমাজের উঁচু তলার মানুষ, শিক্ষিত, পণ্ডিত এর মধ্যে প্রচলিত ছিল । পালযুগের শেষদিকে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা স্থানীয় ভাষায় চর্যাপদ লেখা শুরু করেন । চর্যাপদের মধ্যে বাংলার পরিবেশ ও সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার ছবি পাওয়া যায় । এদের হাত ধরে আদি বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটেছিল । আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে চর্যাপদের পুঁথি উদ্ধার করেন । 
  পাল আমলের শিল্পরীতিকে প্রাচ্য শিল্পরীতি বলা হয় । পালদের স্থাপত্যের মধ্যে ছিল বিহার, স্তূপ, মন্দির । সেগুলি বেশির ভাগ আজ নষ্ট হয়ে গেছে । প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ জৈন্যদের স্তূপ তৈরির রীতি ছিল । প্রথমে গোলাকার হলেও পরে মোচা বা শঙ্কু আকৃতির আকার হয়ে যায় । পাল যুগে সেগুলি শিখরের মতো দেখতে হয়ে যায় । এখন বাংলাদেশের ঢাকার আসরপুর, রাজশাহীর পাহাড়পুর, চট্টগ্রামে ও বর্ধমানের ভরতপুরে বৌদ্ধ স্তূপ পাওয়া গেছে । পাহাড়পুরের সোমপুরী বিহার পাল আমলে উল্লেখযোগ্য বিহার ছিল । মন্দিরের মধ্যে সোমপুরী বিহারের মন্দির ছিল উল্লেখযোগ্য । মন্দির নির্মাণের কাজে পোড়ামাটির ইট, কাদার গাঁথুনি ব্যবহার করা হয় । এখানে মূল মন্দিরের গায়ে রাধা-কৃষ্ণ, বলরাম, শিব, বুদ্ধ, যমুনা ইত্যাদি মূর্তি আছে । এই দেব-দেবীর মধ্যে ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের অনেক বেশি প্রভাব ছিল । ভাস্কর্যের মধ্যে পোড়ামাটির শিল্প সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছিল । ধাতব শিল্প, ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী ধীমান ও তাঁর ছেলে বীত পাল ছিলেন এই সময়ের প্রসিদ্ধ শিল্পী । লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব রচনা করেন গীতগোবিন্দ । ধোয়ী লিখেছিলেন পবন দূত কাব্য । এসময় আরও তিনজন কবি ছিলেন গোবর্ধন, উমাপতিধর ও শরণ । লক্ষণ সেনের মন্ত্রী হলায়ুধ ব্রাহ্মণ সর্বস্বনামে একটি বই লেখেন । রাজ সভার কবিরা সংস্কৃত ভাষাতে সমাজের ধনী ও বিলাসী মানুষদের কথা লিখেছেন । অপর দিকে গরিব মানুষদের নিয়ে লেখা কম পাওয়া যায় ।

  সাধারণভাবে মনে করা হয় পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । ধর্ম বিষয়ে তাঁরা উদার ও সহিষ্ণু ছিলেন । পাল রাজাদের আমলে বৌদ্ধ ধর্ম ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয় । হিউয়েন সাং বাংলায় বৌদ্ধ বিহার ও হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব দেখেছেন । সেন রাজারা গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সমর্থক ছিলেন । পাল যুগের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সেন যুগে ছিলনা । ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সার্বিক প্রভাবের চিহ্ন সর্বত্র স্পষ্ট ছিল । পাল যুগের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সেন যুগে অনেক হ্রাস পায় । রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বৌদ্ধ ধর্মের অতীতের প্রভাব কমে যায় ।


  পাল-সেন যুগে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য ছিল বাংলার অর্থনীতির মূল ভিত্তি । এই সময় বাণিজ্যের গুরুত্ব কমে যায় । এরফলে অর্থনীতি কৃষিনির্ভর হয়ে যায় । মুদ্রা হিসাবে কড়ির বিনিময় হয়ে ওঠে জিনিস কেনে বেচার প্রধান মাধ্যম । এই সময় বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে রাজারা ভূমি দান করতেন । কৃষিজ উৎপাদনের মধ্যে প্রধান ছিল ধান, এছাড়া আখ, সুপারি, নারিকেল, আম, কাঁঠাল, সরষে, তুলো, পান মহুয়া, এলাচ প্রভৃতি উৎপাদিত হত । কাঠ দিয়ে নির্মিত গরুর গাড়ি, নৌকা, পালকি ইত্যাদি ছিল  শিল্পজাত দ্রব্য । বাংলার নদীগুলিতে মাছ পাওয়া যেত । খাদ্য হিসাবে শাক-সবজি, লাউ, বেগুন, কচু, ডুমুর, ঝিঙে খাওয়া হত । এছাড়া আখের গুড়, দুধ, দই, পায়েস, ক্ষীর ছিল তাঁদের নিত্য দিনের খাদ্য সামগ্রী । পশু পাখিদের মদ্যে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, কাক, কোকিল, পায়রা, ঘোড়া, উট, হাতি, বাঘ, হরিণ, মোষ, বানর সাপ, শূকর ইত্যাদি ছিল ।

  কর হিসাবে পাল ও সেন যুগে প্রধানত চার প্রকার কর নেওয়া হত । ভাগ, ভোগ, কর ও হিরণ্য । উৎপন্ন ফসলের এক ষষ্ঠাংশ রাজারা কৃষকদের থেকে যে কর নিতেন একে ভাগবলা হয় । ফুল, ফল, কাঠ, মূল ইত্যাদি রাজারা নিজেদের ভোগের জন্য প্রজাদের কাছ থেকে নিতেন, একে ভোগবলে । করছিল জনগণের আয়ের উপর নির্ধারিত রাজার প্রাপ্য অর্থ । হিরণ্যকরের সঠিক মানে জানা যায়না । তবে রাজারা শস্যের পরিবর্তে নগদ মুদ্রা নিতেন একে হিরণ্য বলা হত । তাছাড়া আরও নানা রকম কর আদায় করা হত হাট, খেয়াঘাট, গো-চারণ ভূমি, নিজেদের নিরাপত্তা ও সমগ্র গ্রামবাসীর উপর কর । কৃষি নির্ভর সমাজ হলেও কিছু নগর ছিল রামাবতী, কর্ণসুবর্ণ, দন্ডভুক্তি, লক্ষণ গড়, তাম্রলিপ্ত, কষীবর্ষ ইত্যাদি ।

  আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নীচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন । ইতিহাস বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুন । পুরো পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । 

আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।

আরো পড়ুন -

1 টি মন্তব্য:

ধন্যবাদ

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷