রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৯

বিপ্লবী সাধক ঋষি শ্রী অরবিন্দের বাংলা জীবনী.


 আমাদের ভারতে অনেক মনীষী জন্ম গ্রহণ করেছেন, কিন্তু একটি মানুষের মধ্যে নানাবিধ গুনের সম্ভার খুব বেশি চোখে পড়েনা । ঋষি অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন দার্শনিক, ঋষি, বিপ্লবী, সাহিত্যিক, সম্পাদক ও সাহিত্য সেবক । ১৮৭২ সালের ১৫ আগস্ট ঋষি অরবিন্দ ঘোষ জন্ম গ্রহণ করেন । পিতার নাম ছিল কৃষ্ণধন ঘোষ, তিনি ডঃ কে.ডি ঘোষ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন । মায়ের নাম ছিল স্বর্ণলতা দেবী । তিনি নানা গুনের অধিকারিণী ছিলেন । কবিতা লেখা, সামাজিক কাজকর্মের মধ্যে তিনি যুক্ত থাকতেন । অরবিন্দের জন্ম হয় ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষের বাড়িতে । অরবিন্দ কথার অর্থ হল পদ্ম ।

  ঋষি অরবিন্দের বাবা ছিলেন একজন সাহেবি কায়দার মানুষ । এদেশীয় লোকেদের সাথে তিনি বেশি মেলামেশা করতেন না । ১৮৭১ সালে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা শেষ করে তিনি সরকারি চিকিৎসক হিসাবে কর্ম জীবন শুরু করেন । ভারতীয় সমাজের রক্ষণশীলতা, সংস্কার, অভ্যাস, রীতিনীতি সমস্ত তিনি ত্যাগ করেছিলেন । তিনি এটি চাইতেন না যে তাঁর সন্তানেরা এদেশের মানুষের মত হোক । তিনি অরবিন্দকে ও তাঁর অন্য দুই সন্তানকে, যখন অরবিন্দের বয়স পাঁচ বছর তখন দার্জিলিং এর ‘লরেটো কনভেন্ট’ স্কুলে ভর্তি করে দেন ।


   বাল্যকাল থেকে অরবিন্দের ইংরেজি আদব কায়দা, খাদ্য, পোশাক সব ছিল সাহেবি ধরনের । তিনি এখানে দুবছর পড়াশোনা করেন । নিজের ছেলেদের নিয়ে ডঃ কে.ডি ঘোষের অনেক উচ্চাশা ছিল । ডঃ কে.ডি ঘোষ ১৮৭৯ সালে আবার ইংল্যান্ডে যান, সেখানে ড্রইট পরিবারে তিনি তাঁর ছেলেদের রাখার ব্যবস্থা করেন । ম্যানচেস্টারে ড্রইট পরিবারে মিঃ রেভারেন্ড ড্রইট, তাঁর স্ত্রী ও তাঁর মায়ের কাছে অরবিন্দরা থাকতে লাগলেন । অরবিন্দ প্রায় ১৪ বছর ইংল্যান্ডে ছিলেন । প্রথম পাঁচ বছর ম্যানচেস্টারে, পরের ছয় বছর লন্ডনে, শেষ তিন বছর ছিলেন কেমব্রিজে ।

 ম্যানচেস্টারে থাকার সময় ড্রইট সাহেব তাকে ল্যাটিন ও ইংরাজি, তাঁর স্ত্রী অঙ্ক ও ভূগোল ও ফরাসি ভাষা শেখাতেন । বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর পাঠ্যসূচীর ভার বাড়তে লাগল । কাব্য, ইতিহাস, সাহিত্য, শেক্সপীয়ার, শেলী ও বাইবেল পড়তে হত । প্রথম পাঁচ বছর এভাবে কাটলো । ১৮৮৪ সালে ড্রইট সাহেব অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলে তাঁর মা ও অরবিন্দ ও তাঁর ভাইদের দেখাশোনার ভার নেন । এবার তাঁরা ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে চলে আসেন । ১৮৮৪ সালে অরবিন্দ ও তাঁর ভাইয়েরা সেন্ট পলস স্কুলে ভর্তি হন ।  সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মিঃ ওয়াকার । তিনি অরবিন্দকে ব্যক্তিগত ভাবে গ্রীক ও নানা বিষয় পাঠে সাহায্য করতেন । স্কুলের পড়া ছাড়াও অরবিন্দ ঘোষ ফরাসি কবিতা, উপন্যাস পাঠ করতেন, গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় কবিতা রচনা করেন ।


 ১৮৮৯ সালে অরবিন্দ সেন্ট পলস থেকে পাশ করেন । সেই বছর তিনি কিং কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষায় বসেন ও সর্বশ্রেষ্ঠ হন । বাৎসরিক ৮০ পাউন্ডের ‘Senior Classical Scholarship’ লাভ করেন । ১৮৯০ সালে ICS প্রবেশিকা পরীক্ষায় জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন । গ্রীক ও ল্যাটিনে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পাশ করেন । অশ্বারোহণ পরীক্ষা না দেওয়ার জন্য তিনি ICS পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেন না । ICS পরীক্ষায় যোগ না দিয়ে তিনি মাতৃভূমির প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ ঘটালেন ।

 ১৯৯০ সালে তিনি বরদাতে আসেন । বরদার মহারাজা গাইকোয়াড়ের  কাছে ২০০ টাকা মাসিক বেতনে কাজ শুরু করেন । অরবিন্দের বাবা শুনেছিলেন অরবিন্দ রুমানিয়া জাহাজে আসছেন । সেই জাহাজটা পর্তুগালের কাছে ডুবে যায় । কিন্তু, অরবিন্দ আসেন এস,এস কার্থেজ জাহাজে । কৃষ্ণধন বাবু একথা সহ্য না করতে পেরে মারা যান । চাকরীতে যোগদান করার পর তাকে জরীপের কাজে, পরে দেওয়ান খানা বা মহাকরণে নিযুক্ত করা হয় । ১৯৯০ সালে বরদা কলেজে অধ্যাপক ও ১৯০৪ সালে অধ্যক্ষ হয়েছিলেন ।


 রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ থাকার কারণে অরবিন্দ পরাধীন ভারতীয় অবস্থার দিকে মনোনিবেশ করেন । সরকারী চাকরী করার সুবাদে অরবিন্দের বাবা ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন অত্যাচার তাকে ব্যথিত করত । অরবিন্দকে তিনি এসব জানাতেন, এরফলে অরবিন্দের মনে ইংরেজদের প্রতি ঘৃণার ভাব তৈরি হয় । লন্ডনে থাকার সময় অরবিন্দ গুপ্ত সমিতির সদস্য হয়েছিলেন । বারোদায় অরবিন্দ ভারতীয় সংস্কৃতির উপর গভীর অধ্যয়ন শুরু করেন । বরদাতে থাকার সময় তিনি ভারতীয় সম্বন্ধে জানার জন্য রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, কালিদাস, সংস্কৃত ইত্যাদি পড়েন । 

  ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশী আন্দোলন করেন । ১৯০৭ সালে তিনি ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকা প্রকাশ করেন । পত্রিকাটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে রাজদ্রোহের অভিযোগে সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করার চেষ্টা করেন । সরকার এই পত্রিকার জনপ্রিয়তা দেখে ভয় পেলেন । ৩০শে জুলাই ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার উপর পুলিশের আক্রমণ হয় । ১৪ আগস্ট অরবিন্দকে গ্রেপ্তার করা হয় । ২৯ শে আগস্ট অরবিন্দকে জামিনে মুক্ত করা হয় । ২৩শে সেপ্টেম্বর বিচারে রায় হয় – বন্দেমাতরম পত্রিকাকে রাজদ্রোহের জন্য দোষী করা হয়, কিন্তু অরবিন্দ মুক্তি পান ।


  ১৯০৮ সালের ৩০ শে এপ্রিল ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে লক্ষ্য করে গাড়িতে বোমা ছোঁড়া হয়েছিল । এই ঘটনার ফলে সারাদেশে হইচই পড়ে যায় । আলিপুর বোমা মামলার আসামি হিসাবে ২রা মে অরবিন্দকে গ্রেপ্তার করা হয় ।  ৫মে তাঁদের আদালতে পেশ করা হয় । অরবিন্দ ও অপর বন্দীদের আলিপুর জেলে স্থানান্তর করে আনা হয় । ১৯০৯ সালে বিচারের রায় প্রকাশিত হয় । এই মামলায় অরবিন্দদের আইনি সাহায্য করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ । অরবিন্দ ও বাকী ৯ জনের বেকসুর খালাস হয় । বাকীদের বিভিন্ন মেয়াদে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর ও কারাবাসের আদেশ হয় । বারীন ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, পরে আপিলের দ্বারা যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ দেওয়া হয় । ১৯০৯ সাল থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত তাঁর ‘কর্মযোগিন’ পত্রিকায় শিক্ষা সম্পর্কে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলি ছিল প্রগতিশীল ও সুদূর প্রসারী ।

 বরদাতে থাকার সময় থেকে তিনি প্রায় প্রাণায়ণ করতেন । কারাগারে থাকার সময় তাঁর অপরিমেয় আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ঘটে । যখন তিনি কারাগার থেকে বেরলেন তখন তিনি যেন এক আলাদা ব্যক্তি । এবার তিনি রাজনৈতিক জীবন পরিত্যাগ করলেন । বিপ্লবী অরবিন্দ ঋষি অরবিন্দে পরিণত হোন । ১৯১০ সালে তিনি ফরাসি অধিকৃত পণ্ডিচেরিতে চলে আসেন । এখানে থাকার সময় তিনি ধর্ম, দর্শন, ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন । তিনি তাঁর জীবনের ৪০ বছর এখানে কাটান । ১৯৫০ সালের ৫ই ডিসেম্বর অরবিন্দের মৃত্যু হয় ।


অরবিন্দ ঘোষের রচিত উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ:
The age of Kalidasa
A System of National Education
The Renaissance in India
Speeches of Aurobinda
Mother India
কারাকাহিনী
ধর্ম ও জাতীয়তা
অরবিন্দের পত্র
যোগ সাধনার ভিত্তি

আমাদের আরও পোস্ট পড়ুন - 
 আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোনও প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন । জীবনী বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে জীবনী লেখাটির উপর ক্লিক করুন । পুরো পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।


অর্ডার করতে নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন।

আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে আপনার প্রয়োজন অনুসারে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ধন্যবাদ

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷