বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাংলা জীবনী .


  বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ২৪ মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ শাসিত ভারতে এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর বাবার নাম ফকির আহমেদ ও মায়ের নাম জাহেদা খাতুন । তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি চুরুলিয়া অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার আসানসোলের নিকট অবস্থিত । কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল "দুখু মিয়া" পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ  – দুই বাংলাতেই তার কবিতা  গান সমানভাবে সমাদৃত বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম

 নজরুলের যখন দশ বছর বয়স তখন তিনি গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । তাঁর পিতার মৃত্যু হলে তাকে বাধ্য হয়ে উপার্জনের চেষ্টা করতে হয় । গ্রামের মৌলবিদের সাহায্যে মক্তবে ছোটদের পড়া মুখস্থ করানোর জন্য এক পীরের দরগায় কাজের ব্যবস্থা হয় । এখানে দুই বছর তাঁর অতিবাহিত হয় । শৈশব থেকে তিনি লোকনাট্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন । এরপর তিনি ভ্রাম্যমাণ ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দেন । সেই দলের জন্য তিনি গান গাইতেন, গান ও পালা রচনা করতেন । তিনি পালা গান রচনা করতে গিয়ে হিন্দু দেব-দেবী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারেন ।
 
এরপর তিনি বাসুদেবের শখের কবি গানে যোগ দেন । এখানে তিনি গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন ও নিজে গান গেয়েছেন । সেখান থেকে তাঁকে এক বাঙালি খ্রিস্টান গার্ড বাবুর্চি কাজের জন্য নিয়ে যান । সেখানে ভাল না লাগার জন্য তিনি আসানসোলে এক চা রুটির দোকানে কাজ করতে লাগলেন । দোকানে থাকার যায়না না থাকার জন্য তিনি পাশে এক তেতলা বাড়ির সিঁড়ির নীচে থাকতেন । সেই বাড়িটি ছিল এক পুলিশ ইন্সপেক্টর কাজী রফিউল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী শ্যামসুন্নেসার । তাঁরা নজরুলকে ময়মনসিংহ এর দরিরাম পুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন । এরপর তিনি রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন ।
 ১৯১০ সালে নজরুল বিপ্লবী নিবারণ চন্দ্র ঘটকের সাথে পরিচিত হন, যিনি তাঁর শিক্ষক ছিলেন । পরবর্তীকালে বিদ্যালয়য়ে যোগদানের সময় কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক ছিলেন তাঁর প্রধান শিক্ষক । তাঁর সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস১৯১৪ সালে পৃথিবীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখা যায় । ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন সেনাদলে যোগ দিয়ে তিনি প্রথমে লাহোর, পেশোয়ার, তারপরে যান করাচীতে তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ অধীনস্থ ৪৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেনা বাহিনীতে যুক্ত ছিলেন । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালে এই রেজিমেন্ট নিষিদ্ধ করা হলে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন ।
 ১৯২১ সালে কুমিল্লায় গিয়ে নার্গিস আসার খানমের সাথে তাঁর বিবাহ হয় । কিন্তু, বিবাহে ঝামেলা হওয়ার জন্য তিনি তাঁর পরিচিত সেনগুপ্তের বাড়ি চলে আসেন । পরে প্রমীলা দেবী ও নজরুল তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের অবস্থান ছিল কঠোর
 
কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন নজরুল রবীন্দ্রনাথ, পারস্য কবি হাফেজ ও খৈয়াম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । এখান থেকেই নজরুলের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ শুরু হয়এই সময় ভারতীয়রা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়িয়েছিল । তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে ব্রিটিশদের নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করেছিলেন । প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে তিনি গান, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতে শুরু করেন । নজরুল এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন এবং স্বরচিত স্বদেশী গান পরিবেশন করে পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন  ১৩২৬ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় মুসলমান নামক সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয় । এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন তিনি কুমিল্লা, মেদিনীপুর, হুগলিফরিদপুর, বাঁকুড়া এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করেন
 তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে ভারতীয় যুবকদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে প্রেরণা যোগাতেন । ব্রিটিশ শাসকরা ভয় পেলেন যে – নজরুলের লেখা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্ররোচিত করবে ।
 ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সমগ্র বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি হয় । বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তাঁর কবিতা শুধু ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে প্রতীবাদ নয়, সমাজের সমস্ত রকম অসাম্য, অন্যায়, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে । তাঁর কবিতার আর একটি বিশেষত্ব হল হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ঐতিহ্যের সার্থক মেলবন্ধন ।
 ১৯২২ সালে নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন । ব্রিটিশরা ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় তল্লাশি চালায়, কবিকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় । এরপর তাঁকে হুগলী জেলে স্থানান্তরিত করা হয় । তিনি এখানে অনশন শুরু করেন । এক মাসের বেশি তিনি অনশন করেন । ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে নজরুলকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় । ১৯২৫ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা প্রকাশ করেন ।
 বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর এত কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ আর গান কেউ লেখেন নি । ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিতনজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গান গুলিকে নজরুল সঙ্গীত বলা হয় । তাঁর রচিত বইগুলি হল – অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণীমনসা, প্রলয় শিখা ইত্যাদি । নাটক – দাতা কর্ণ, কবি কালিদাস, রক্তকমল, মহুয়া, জাহাঙ্গীর, কারাগার, সাবিত্রী, আলেয়া, সর্বহারা, সতী ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার জগত্তারিণী স্বর্ণপদক নজরুলকে প্রদান করা হয় ১৯৬০ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণে  ভূষিত করা হয়
  
১৯৪০ সালে কবি স্ত্রী প্রমীলা কঠিন পক্ষাঘাত হয় । কবি মানসিক যন্ত্রণায় ভেঙে পড়েন, তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে । ১৯৪২ সালে তিনি একেবারে মূক হয়ে যান । দেশে বিভিন্ন ভাবে তাঁদের চিকিৎসা করা হয় । এখানে চিকিৎসায় সফল না হওয়ার জন্য বিদেশে লন্ডনে, ভিয়েনায় পাঠানো হয় ।  কবির স্ত্রীর মৃত্যু হয় ১৯৬২ সালে । ১৯৭১ সালে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ তৈরি হয় । ১৯৭২ সালে নজরুলকে বাংলাদেশের ঢাকাতে নিয়ে যাওয়া হয় । ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারী আদেশ জারী করা হয় ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন   কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয় ।  বাংলাদেশে তার মৃত্যু উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয় এবং ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়
 আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন । জীবনী বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে জীবনী লেখাটির উপর ক্লিক করুন । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ 


আমাদের আরও পোস্ট পড়ুন -

আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ধন্যবাদ

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷