বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাংলা জীবনী .
বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ২৪ মে ১৮৯৯
খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ শাসিত ভারতে এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে
জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবার নাম ফকির আহমেদ ও
মায়ের নাম জাহেদা খাতুন । তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি,
ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ
ও দার্শনিক । বাংলা ভাষার
অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী
এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি । চুরুলিয়া অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার আসানসোলের নিকট
অবস্থিত । কাজী
নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল "দুখু মিয়া" । পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই
বাংলাতেই তার কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত । বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী
নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম ।
নজরুলের যখন দশ বছর বয়স তখন তিনি গ্রামের মক্তব
থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । তাঁর পিতার মৃত্যু হলে তাকে বাধ্য হয়ে
উপার্জনের চেষ্টা করতে হয় । গ্রামের মৌলবিদের সাহায্যে মক্তবে ছোটদের পড়া মুখস্থ
করানোর জন্য এক পীরের দরগায় কাজের ব্যবস্থা হয় । এখানে দুই বছর তাঁর অতিবাহিত হয় ।
শৈশব থেকে তিনি লোকনাট্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন । এরপর তিনি ভ্রাম্যমাণ
‘লেটো’ গানের দলে যোগ দেন । সেই দলের জন্য তিনি গান গাইতেন, গান ও পালা রচনা করতেন
। তিনি পালা গান রচনা করতে গিয়ে হিন্দু দেব-দেবী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে
পারেন ।
এরপর তিনি বাসুদেবের
শখের কবি গানে যোগ দেন । এখানে তিনি গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন ও নিজে গান গেয়েছেন
। সেখান থেকে তাঁকে এক বাঙালি খ্রিস্টান গার্ড বাবুর্চি কাজের জন্য নিয়ে যান । সেখানে
ভাল না লাগার জন্য তিনি আসানসোলে এক চা রুটির দোকানে কাজ করতে লাগলেন । দোকানে
থাকার যায়না না থাকার জন্য তিনি পাশে এক তেতলা বাড়ির সিঁড়ির নীচে থাকতেন । সেই বাড়িটি
ছিল এক পুলিশ ইন্সপেক্টর কাজী রফিউল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী শ্যামসুন্নেসার । তাঁরা
নজরুলকে ময়মনসিংহ এর দরিরাম পুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন । এরপর তিনি রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ
স্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন ।
১৯১০ সালে নজরুল বিপ্লবী নিবারণ চন্দ্র ঘটকের সাথে
পরিচিত হন, যিনি তাঁর শিক্ষক ছিলেন । পরবর্তীকালে বিদ্যালয়য়ে যোগদানের সময় কবি
কুমুদরঞ্জন মল্লিক ছিলেন তাঁর প্রধান শিক্ষক । তাঁর সান্নিধ্য নজরুলের
অনুপ্রেরণার একটি উৎস । ১৯১৪ সালে পৃথিবীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখা যায় । ১৯১৭
খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে
সৈনিক হিসেবে যোগ দেন । সেনাদলে যোগ দিয়ে তিনি প্রথমে লাহোর, পেশোয়ার, তারপরে যান করাচীতে । তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭
খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত । তিনি ব্রিটিশ অধীনস্থ
৪৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেনা বাহিনীতে যুক্ত ছিলেন । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০
সালে এই রেজিমেন্ট নিষিদ্ধ করা হলে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন ।
১৯২১ সালে কুমিল্লায় গিয়ে নার্গিস আসার খানমের
সাথে তাঁর বিবাহ হয় । কিন্তু, বিবাহে ঝামেলা হওয়ার জন্য তিনি তাঁর পরিচিত
সেনগুপ্তের বাড়ি চলে আসেন । পরে প্রমীলা দেবী ও নজরুল তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা,
ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের
অবস্থান ছিল কঠোর ।
কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয়
মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন । নজরুল রবীন্দ্রনাথ,
পারস্য কবি হাফেজ ও খৈয়াম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । এখান থেকেই নজরুলের রাজনৈতিক
চেতনার বিকাশ শুরু হয় । এই সময় ভারতীয়রা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উঠে
দাঁড়িয়েছিল । তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে ব্রিটিশদের নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করেছিলেন ।
প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে তিনি গান, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতে শুরু করেন । নজরুল এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক
সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন এবং স্বরচিত স্বদেশী গান পরিবেশন করে পরাধীনতার বিরুদ্ধে
সংগ্রামে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন । ১৩২৬ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় মুসলমান নামক সাহিত্য
পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয় । এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের
বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন । তিনি
কুমিল্লা, মেদিনীপুর, হুগলি, ফরিদপুর, বাঁকুড়া এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ
করেন ।
তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে ভারতীয় যুবকদের স্বাধীনতার
জন্য লড়াই করতে প্রেরণা যোগাতেন । ব্রিটিশ শাসকরা ভয় পেলেন যে – নজরুলের লেখা
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্ররোচিত করবে ।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা
প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সমগ্র বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি হয় । বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল
সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন । তাঁর কবিতা শুধু ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে প্রতীবাদ নয়, সমাজের সমস্ত রকম অসাম্য,
অন্যায়, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে । তাঁর কবিতার আর একটি বিশেষত্ব হল
হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ঐতিহ্যের সার্থক মেলবন্ধন ।
১৯২২ সালে নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন
। ব্রিটিশরা ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় তল্লাশি চালায়, কবিকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা
হয় । এরপর তাঁকে হুগলী জেলে স্থানান্তরিত করা হয় । তিনি এখানে অনশন শুরু করেন । এক
মাসের বেশি তিনি অনশন করেন । ১৯২৩ সালের
ডিসেম্বরে নজরুলকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় । ১৯২৫ সালে তিনি সাপ্তাহিক
‘লাঙ্গল’ পত্রিকা প্রকাশ করেন ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর এত কবিতা, গল্প,
নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ আর গান কেউ লেখেন নি । ছোটগল্প, উপন্যাস,
নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত । নজরুলের গানের সংখ্যা চার
হাজারের বেশি । তাঁর রচিত ও সুরারোপিত
গান গুলিকে নজরুল সঙ্গীত বলা হয় । তাঁর রচিত বইগুলি হল – অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি,
সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণীমনসা, প্রলয় শিখা ইত্যাদি । নাটক – দাতা কর্ণ, কবি
কালিদাস, রক্তকমল, মহুয়া,
জাহাঙ্গীর, কারাগার, সাবিত্রী,
আলেয়া, সর্বহারা, সতী । ১৯৪৫ সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার জগত্তারিণী স্বর্ণপদক
নজরুলকে প্রদান করা হয় । ১৯৬০ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান
পদ্মভূষণে ভূষিত করা হয় ।
১৯৪০ সালে কবি স্ত্রী প্রমীলা কঠিন পক্ষাঘাত হয়
। কবি মানসিক যন্ত্রণায় ভেঙে পড়েন, তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে । ১৯৪২ সালে তিনি
একেবারে মূক হয়ে যান । দেশে বিভিন্ন ভাবে তাঁদের চিকিৎসা করা হয় । এখানে চিকিৎসায়
সফল না হওয়ার জন্য বিদেশে লন্ডনে, ভিয়েনায় পাঠানো হয় । কবির স্ত্রীর মৃত্যু হয় ১৯৬২ সালে । ১৯৭১ সালে
নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ তৈরি হয় । ১৯৭২ সালে নজরুলকে বাংলাদেশের ঢাকাতে নিয়ে যাওয়া
হয় । ১৯৭৬
খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারী আদেশ জারী করা
হয় । ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট
তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ
করা হয় । বাংলাদেশে তার মৃত্যু উপলক্ষে
দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয় এবং ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক
মিনিট নীরবতা পালন করা হয় ।
আমাদের লেখা আপনার
কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার
বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন । জীবনী বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে
নিচে জীবনী লেখাটির উপর ক্লিক করুন । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
আমাদের আরও পোস্ট পড়ুন -
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
ধন্যবাদ
মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷