বাংলায় সুলতানি আমলে শিল্প-স্থাপত্য ও ভাস্কর্য কেমন ছিল ?.
দিল্লিতে সুলতানি সাম্রাজ্যের ভাঙনের ফলে ভারতে
একাধিক স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠেছিল । সেই আঞ্চলিক রাজ্যগুলি তাদের নিজের চেষ্টায়
দিল্লি সুলতানদের মত বিশাল ও ব্যাপক না হলেও, ইন্দো-ইসলামীয় স্থাপত্য ধারায় স্থাপত্য
নির্মাণ করেন । ঐতিহাসিক দিক থেকে এইসব স্থাপত্য কর্মের গুরুত্ব কম নয় । স্থানীয়
উপকরণ ও স্থানীয় শিল্পীদের দ্বারা এইসব স্থাপত্য গড়ে ওঠে । এইসব আঞ্চলিক স্থাপত্যে
স্থানীয় স্থাপত্য রীতি ও বৈশিষ্ট্যের প্রভাব ছিল দেখার মত । ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে
এরকম স্থাপত্য ও শিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায় । আমরা এখন জানবো শুধু আমাদের
বাংলাদেশের (অবিভক্ত বাংলা) সুলতানি আলমের স্থাপত্য, শিল্প ও ভাস্কর্য সম্পর্কে ।
বাংলাদেশে মুসলমান শাসকরা ছড়িয়ে পড়ে খ্রিস্টীয়
ত্রয়োদশ শতকে । বাংলার সেই স্বাধীন ও অর্ধ স্বাধীন অঞ্চলে নানা স্থানে তাঁদের
প্রশাসনিক কেন্দ্র তৈরি করেছিল । সেই সময় বাংলার স্থাপত্য নির্মাণের মূল গঠন ভঙ্গি
ছিল ইসলামীয় রীতি । কাঁচামাল ও কারুকার্যে বাংলার লৌকিক রীতিও দেখা যায় । প্রধানত
গৌড় ও পাণ্ডুয়াকে কেন্দ্র করে বাংলার স্থাপত্য বিকশিত হয়েছিল । সেইসব স্থাপত্যের
মধ্যে বর্তমানে খুব কম টিকে আছে, আবার যেগুলি আছে তাদের অবস্থা ভগ্ন ও জরাজীর্ণ ।
এখানে ইটের ব্যবহার করা হত । বাড়ি ও মন্দির গুলির চাল ঢালু করা হত, কারণ বৃষ্টির
জল সহজে দাঁড়াতে না পারে । এই নির্মাণ পদ্ধতিকে বলা হয় বাংলা । পুরনো মন্দির গুলি
একই ধাঁচে তৈরি করা । পরপর দুটি কাঠামোকে পাশাপাশি জুড়ে তৈরি করা হলে তাকে বলা হত
জোড়-বাংলা ।
এই সময়
মন্দির গুলি বেশির ভাগ দেওয়াল গুলিতে টেরাকোটা বা পোড়ামাটির কাজ করা হত । এগুলি
এখন বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর ও বাংলার নানা স্থানে দেখতে পাওয়া যায় ।
আয়তক্ষেত্রাকার কাঠামোর উপরে অনেক গুলি চুড়া ব্যবহার করে মন্দির বানানো হত,
সেগুলিকে চুড়া বলা হয় । একটি চুড়া থাকলে এক রত্ন, আবার পাঁচটি চুড়া থাকলে তাকে বলা
হয় পঞ্চরত্ন মন্দির । এসময় আবার চাল বা চালা ভিত্তিক মন্দির বানানোর রীতি ছিল ।
মন্দিরের মাথায় চালার সংখ্যা হিসাবে এগুলিকে বলা হত একচালা, দো-চালা ইত্যাদি ।
এই
সময়ের বাংলার স্থাপত্য শিল্পকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে । প্রথম পর্যায় ছিল ১২০২
থেকে ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । সেসব স্থাপত্য অধিকাংশ রাজধানী গৌড়কে কেন্দ্র করে
তৈরি হয়েছিল । এই সময় ইট ও পাথর দিয়ে গম্বুজাকৃতি মসজিদ তৈরি হয় । মসজিদ গুলিতে
টেরাকোটা বা পোড়ামাটির অলংকরণ ছিল । এগুলির কোন কার্নিশ ছিল না । এই পর্বের ইমারত
গুলি ত্রিবেণী, পাণ্ডুয়া, সপ্তগ্রাম স্থান গুলিতে নির্মিত হয় । ত্রিবেণীতে জাফর খানের
সমাধির ভগ্নাবশেষ ও বসিরহাটে ছড়িয়ে থাকা কিছু স্তূপ ছাড়া সেই সময়ের স্থাপত্য আজ
টিকে নেই ।
আরো পড়ুন-
দ্বিতীয় পর্বের সময়কাল হিসাবে
ধরা হয় ১৩৪০ থেকে ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । সেই সময় স্থাপত্যকর্ম পাণ্ডুয়াকে
কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল । দ্বিতীয় পর্বের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল মালদহের
পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ । সুলতান সিকন্দর শাহ ১৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নতুন রাজধানী
পাণ্ডুয়াতে এই মসজিদ নির্মাণ করেন । দামাস্কাসের আদি মসজিদের সাথে আদিনা মসজিদের
সীমানা প্রায় সমান । এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ৪০০ ফুট ও ১৩০ ফুট । মসজিদের
উপরের অংশের খিলান ও গম্বুজ প্রধানত ইট দিয়ে তৈরি হয়েছিল ।
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন
যে – মুসলিম স্থাপত্যের প্রথম পর্যায়ের উপকরণ গুলি হিন্দু স্থাপত্য থেকে নেওয়া
হয়েছে । আদিনা মসজিদের সামনের উপ কাঠামো নির্মাণের পাথর বা দেওয়ালের অভ্যন্তরে
খোদাই করা পাথর, মূর্তি ইত্যাদি অন্য কোন স্থাপত্য থেকে নেওয়া হয়েছে । মনে করা হয়
যে – এগুলি লক্ষণাবতী বা তার কাছাকাছি কোন হিন্দু স্থাপত্য বা অট্টালিকা থেকে
সংগ্রহ করা হয়েছে । আদিনা মসজিদের গাম্ভীর্য ও শিল্পচর্চায় রাজকীয় মর্যাদার উন্নত
একটি শিল্প সৃষ্টি হিসাবে স্বীকার করা হয়েছে ।
বাংলার
সুলতানি স্থাপত্যের তৃতীয় পর্বের সময়কাল হিসাবে ধরা হয় ১৪৪২ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত । তৃতীয় পর্বে বাংলায় ইন্দো-ইসলামিয় স্থাপত্য শিল্প সবথেকে উন্নত হয়েছিল ।
এই সময় নতুন স্থাপত্য ধারা দেখা যায় । বাংলার আদ্র জলবায়ুর উপযোগী স্থাপত্যের উপর
জোর দেওয়া হয় । এই সময় ছাদের জল তাড়াতাড়ি সরানোর জন্য ছাদ ঢালু ও বক্র করা হয় । তৃতীয়
পর্বের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হল – একলাখি সমাধি, দাখিল দরওয়াজা, তাঁতিপাড়া
মসজিদ, ছোটো সোনা মসজিদ, বড়োসোনা মসজিদ, কদম রসুলের মসজিদ ইত্যাদি ।
তৃতীয় ধারায় প্রথম
প্রকাশ দেখা যায় পাণ্ডুয়ায় সুলতান জালালউদ্দিন মহম্মদ শাহ (যদু) একলাখি স্মৃতি সৌধ
। এই মসজিদের টেরাকোটার কাজ ও অর্ধ গোলক আকৃতি অন্যতম আকর্ষণীয় । এর চুড়া অষ্টভুজাকৃতি,
যা দূর থেকে দেখলে মনে হবে এটি হয়তো দ্বিতল । এটি নির্মিত হয় ১৪২৫ সালে । গৌড়ের
দাখিল দরওয়াজা সে সময়ের আরও একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য । ১৪৬৫ সালে সুলতান বারবক
শাহ এটি নির্মাণ করেছিলেন । এটি একটি বিজয় তোরণ হিসাবে গৌড় দুর্গের উত্তর প্রাকারের
মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ।
গৌড়ের তাঁতিপাড়া মসজিদটি ১৪৮০ সালে
তৈরি হয় । নির্মাণ শৈলী স্থায়িত্বের দিক থেকে এটি দাখিল দরওয়াজা থেকে অনেক উন্নত ।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে নির্মাণ করা হয় ছোটো সোনা মসজিদ । ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে
নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয় । গৌড়ের মধ্যে সবথেকে বড়ো মসজিদ হল বড়োসোনা মসজিদ । এই
মসজিদে উজ্জ্বল মিনাকরা বহু বর্ণের টালি ব্যবহার করা হয়েছে । জন মার্শালের মতে –
এই মসজিদের নকসা দ্রাবিড় স্থাপত্যের অনুরূপ ।
আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে
নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার
করুন । ইতিহাস বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুন । পুরো
পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
আমাদের আরও পোস্ট পড়ুন -
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
ধন্যবাদ
মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷