মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

বাংলায় সুলতানি আমলে শিল্প-স্থাপত্য ও ভাস্কর্য কেমন ছিল ?.


দিল্লিতে সুলতানি সাম্রাজ্যের ভাঙনের ফলে ভারতে একাধিক স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠেছিল । সেই আঞ্চলিক রাজ্যগুলি তাদের নিজের চেষ্টায় দিল্লি সুলতানদের মত বিশাল ও ব্যাপক না হলেও, ইন্দো-ইসলামীয় স্থাপত্য ধারায় স্থাপত্য নির্মাণ করেন । ঐতিহাসিক দিক থেকে এইসব স্থাপত্য কর্মের গুরুত্ব কম নয় । স্থানীয় উপকরণ ও স্থানীয় শিল্পীদের দ্বারা এইসব স্থাপত্য গড়ে ওঠে । এইসব আঞ্চলিক স্থাপত্যে স্থানীয় স্থাপত্য রীতি ও বৈশিষ্ট্যের প্রভাব ছিল দেখার মত । ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এরকম স্থাপত্য ও শিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায় । আমরা এখন জানবো শুধু আমাদের বাংলাদেশের (অবিভক্ত বাংলা) সুলতানি আলমের স্থাপত্য, শিল্প ও ভাস্কর্য সম্পর্কে ।

 বাংলাদেশে মুসলমান শাসকরা ছড়িয়ে পড়ে খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে । বাংলার সেই স্বাধীন ও অর্ধ স্বাধীন অঞ্চলে নানা স্থানে তাঁদের প্রশাসনিক কেন্দ্র তৈরি করেছিল । সেই সময় বাংলার স্থাপত্য নির্মাণের মূল গঠন ভঙ্গি ছিল ইসলামীয় রীতি । কাঁচামাল ও কারুকার্যে বাংলার লৌকিক রীতিও দেখা যায় । প্রধানত গৌড় ও পাণ্ডুয়াকে কেন্দ্র করে বাংলার স্থাপত্য বিকশিত হয়েছিল । সেইসব স্থাপত্যের মধ্যে বর্তমানে খুব কম টিকে আছে, আবার যেগুলি আছে তাদের অবস্থা ভগ্ন ও জরাজীর্ণ । এখানে ইটের ব্যবহার করা হত । বাড়ি ও মন্দির গুলির চাল ঢালু করা হত, কারণ বৃষ্টির জল সহজে দাঁড়াতে না পারে । এই নির্মাণ পদ্ধতিকে বলা হয় বাংলা । পুরনো মন্দির গুলি একই ধাঁচে তৈরি করা । পরপর দুটি কাঠামোকে পাশাপাশি জুড়ে তৈরি করা হলে তাকে বলা হত জোড়-বাংলা ।

 এই সময় মন্দির গুলি বেশির ভাগ দেওয়াল গুলিতে টেরাকোটা বা পোড়ামাটির কাজ করা হত । এগুলি এখন বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর ও বাংলার নানা স্থানে দেখতে পাওয়া যায় । আয়তক্ষেত্রাকার কাঠামোর উপরে অনেক গুলি চুড়া ব্যবহার করে মন্দির বানানো হত, সেগুলিকে চুড়া বলা হয় । একটি চুড়া থাকলে এক রত্ন, আবার পাঁচটি চুড়া থাকলে তাকে বলা হয় পঞ্চরত্ন মন্দির । এসময় আবার চাল বা চালা ভিত্তিক মন্দির বানানোর রীতি ছিল । মন্দিরের মাথায় চালার সংখ্যা হিসাবে এগুলিকে বলা হত একচালা, দো-চালা ইত্যাদি ।

 এই সময়ের বাংলার স্থাপত্য শিল্পকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে । প্রথম পর্যায় ছিল ১২০২ থেকে ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । সেসব স্থাপত্য অধিকাংশ রাজধানী গৌড়কে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল । এই সময় ইট ও পাথর দিয়ে গম্বুজাকৃতি মসজিদ তৈরি হয় । মসজিদ গুলিতে টেরাকোটা বা পোড়ামাটির অলংকরণ ছিল । এগুলির কোন কার্নিশ ছিল না । এই পর্বের ইমারত গুলি ত্রিবেণী, পাণ্ডুয়া, সপ্তগ্রাম স্থান গুলিতে নির্মিত হয় । ত্রিবেণীতে জাফর খানের সমাধির ভগ্নাবশেষ ও বসিরহাটে ছড়িয়ে থাকা কিছু স্তূপ ছাড়া সেই সময়ের স্থাপত্য আজ টিকে নেই ।
আরো পড়ুন-
 দ্বিতীয় পর্বের সময়কাল হিসাবে ধরা হয় ১৩৪০ থেকে ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । সেই সময় স্থাপত্যকর্ম পাণ্ডুয়াকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল । দ্বিতীয় পর্বের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল মালদহের পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ । সুলতান সিকন্দর শাহ ১৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নতুন রাজধানী পাণ্ডুয়াতে এই মসজিদ নির্মাণ করেন । দামাস্কাসের আদি মসজিদের সাথে আদিনা মসজিদের সীমানা প্রায় সমান । এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ৪০০ ফুট ও ১৩০ ফুট । মসজিদের উপরের অংশের খিলান ও গম্বুজ প্রধানত ইট দিয়ে তৈরি হয়েছিল । 

  অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে – মুসলিম স্থাপত্যের প্রথম পর্যায়ের উপকরণ গুলি হিন্দু স্থাপত্য থেকে নেওয়া হয়েছে । আদিনা মসজিদের সামনের উপ কাঠামো নির্মাণের পাথর বা দেওয়ালের অভ্যন্তরে খোদাই করা পাথর, মূর্তি ইত্যাদি অন্য কোন স্থাপত্য থেকে নেওয়া হয়েছে । মনে করা হয় যে – এগুলি লক্ষণাবতী বা তার কাছাকাছি কোন হিন্দু স্থাপত্য বা অট্টালিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে । আদিনা মসজিদের গাম্ভীর্য ও শিল্পচর্চায় রাজকীয় মর্যাদার উন্নত একটি শিল্প সৃষ্টি হিসাবে স্বীকার করা হয়েছে ।


 বাংলার সুলতানি স্থাপত্যের তৃতীয় পর্বের সময়কাল হিসাবে ধরা হয় ১৪৪২ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । তৃতীয় পর্বে বাংলায় ইন্দো-ইসলামিয় স্থাপত্য শিল্প সবথেকে উন্নত হয়েছিল । এই সময় নতুন স্থাপত্য ধারা দেখা যায় । বাংলার আদ্র জলবায়ুর উপযোগী স্থাপত্যের উপর জোর দেওয়া হয় । এই সময় ছাদের জল তাড়াতাড়ি সরানোর জন্য ছাদ ঢালু ও বক্র করা হয় । তৃতীয় পর্বের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হল – একলাখি সমাধি, দাখিল দরওয়াজা, তাঁতিপাড়া মসজিদ, ছোটো সোনা মসজিদ, বড়োসোনা মসজিদ, কদম রসুলের মসজিদ ইত্যাদি ।

তৃতীয় ধারায় প্রথম প্রকাশ দেখা যায় পাণ্ডুয়ায় সুলতান জালালউদ্দিন মহম্মদ শাহ (যদু) একলাখি স্মৃতি সৌধ । এই মসজিদের টেরাকোটার কাজ ও অর্ধ গোলক আকৃতি অন্যতম আকর্ষণীয় । এর চুড়া অষ্টভুজাকৃতি, যা দূর থেকে দেখলে মনে হবে এটি হয়তো দ্বিতল । এটি নির্মিত হয় ১৪২৫ সালে । গৌড়ের দাখিল দরওয়াজা সে সময়ের আরও একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য । ১৪৬৫ সালে সুলতান বারবক শাহ এটি নির্মাণ করেছিলেন । এটি একটি বিজয় তোরণ হিসাবে গৌড় দুর্গের উত্তর প্রাকারের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ।

 গৌড়ের তাঁতিপাড়া মসজিদটি ১৪৮০ সালে তৈরি হয় । নির্মাণ শৈলী স্থায়িত্বের দিক থেকে এটি দাখিল দরওয়াজা থেকে অনেক উন্নত । আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে নির্মাণ করা হয় ছোটো সোনা মসজিদ । ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয় । গৌড়ের মধ্যে সবথেকে বড়ো মসজিদ হল বড়োসোনা মসজিদ । এই মসজিদে উজ্জ্বল মিনাকরা বহু বর্ণের টালি ব্যবহার করা হয়েছে । জন মার্শালের মতে – এই মসজিদের নকসা দ্রাবিড় স্থাপত্যের অনুরূপ ।

 
আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন । ইতিহাস বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুন । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ 
আমাদের আরও পোস্ট পড়ুন -

আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ধন্যবাদ

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷