রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৯

হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন দিক কেমন ছিল ?.


 প্রাচীন ভারতে সিন্ধু নদের তীরে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেটি সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত । পড়ে মহেঞ্জোদারোতে এই সভ্যতার কেন্দ্র আবিষ্কার হয় । হরপ্পা কেন্দ্রটি ছিল অনেক বড়ো । তাই এই সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা নামেও পরিচিত । ১৯২০ সালে হরপ্পা ও ১৯২১ সালে মহেঞ্জোদারো নামে দুটি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয় । হরপ্পা সভ্যতাকে প্রায় ইতিহাস যুগের সভ্যতা বলা হয় । কারণ এখানে প্রাপ্ত লিপিগুলি পড়া সম্ভব হয়নি । এখানের মানুষেরা তামা ও ব্রোঞ্জ ধাতুর ব্যবহার করত । সময়কাল হিসাবে ধরা হয় আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত । এই সভ্যতার বিস্তার ছিল প্রায় সাত লক্ষ বর্গ কিলোমিটার । সীমানা ছিল উত্তরে আফগানিস্তান, জম্বুর মান্ডা অঞ্চল, দক্ষিণে মহারাষ্ট্রের দৈমাবাদ, কচ্ছ, গুজরাত অঞ্চল, পূর্বে আলমগির পুর, পশ্চিম সীমা পাকিস্তানের বালুচিস্তান পর্যন্ত ।

 চার্লস ম্যাসন পাঞ্জাবের সাহিওয়াল জেলায় গিয়েছিলেন ১৮২৬ সালে । তিনি ধারণা করেন যে এখানে আলেকজান্ডার ও পুরুর যুদ্ধ হয়েছিল । এরপর আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৫০ সালে এই এলাকায় যান । তিনি প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন । তিনি সেখানে দেখেন যে ইট ব্যবহার করা হচ্ছে রেল লাইন বানানোর কাজে । সেখানে সেই ইটের সাথে কিছু লিপি ও বাসনপত্র পাওয়া যায় । কেউ এবিষয়ে তেমন গুরুত্ব তখন দেননি । শেষে ১৯২০ সালে দয়ারাম সাহানি হরপ্পায় এবং ১৯২১ সালে মহেঞ্জোদারোতে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় খননকার্য করেন । জন মার্শাল ১৯২৪ সালে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সম্পর্কে বিবরণ পেশ করলে বিশ্ববাসী সবিস্তাতে এই সভ্যতার কথা জানতে পারেন ।


 এখানে শাসক কারা বা কে ছিলেন সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়না । মহেঞ্জোদারোতে একটি পুরুষের মূর্তি পাওয়া গেছে । তাঁর চোখ আধবোজা, চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো, গালে চাপদাড়ি, আবার বা কাঁধে চাদর আছে । ইনি কি তবে হরপ্পার রাজা না পুরোহিত তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে । আবার অনেকের মতে – ইনি একজন পুরোহিত রাজা । তবে এর নিশ্চিত প্রমাণ এখন পাওয়া যায়নি ।

 হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছিল দুটো বড়ো নগর । হরপ্পা সভ্যতাতে প্রথম নগর তৈরি হয়েছিল । অনেকে তাই একে প্রথম নগরায়ন বলেন । এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় যেমন – বানাওয়ালি, ঢোলবিরা, কুনতাসি, কালিবঙ্গান, লোথাল, সুর কোটাডা ইত্যাদি ছোটো বড়ো শহর পাওয়া গেছে । হরপ্পার নগরগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল । একদিকে থাকত উঁচু এলাকা যাকে সিটাডেল বলা হয় । এটি একটি উঁচু ঢিপির উপর বানানো হত । নগরগুলি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা থাকত ।


  মহেঞ্জোদারোতে ১৮০ ফুট/১০৮ ফুটের একটি স্নানাগার পাওয়া গেছে । এতে জল পরিষ্কার করার ব্যবস্থা ছিল । জল ঢোকানো ও জল বের করে দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল । এর চারিদিকে ৮ ফুট উঁচু ইটের দেওয়াল ছিল ও চারপাশে ছোটো ছোটো ঘর ছিল । হরপ্পায় খাদ্য মজুত করে রাখার জন্য পাকা ঘরের মত দুটি কেন্দ্র তৈরি করা হয় । সেখানে শুকনো খাদ্যশস্য রাখার ব্যবস্থা ছিল । হাওয়া চলাচলের জন্য দেওয়ালের গায়ে অনেক ঘুলঘুলি ছিল । পাশে থাকা ঘরগুলি শস্য পেষাই করা শ্রমিকদের বলে মনে করা হয় ।

 শহরের উঁচু অংশগুলিতে সম্ভবত প্রশাসকরা থাকতেন । সেগুলি আবার দুর্গ ও পরিখা দিয়ে ঘেরা থাকত । এখানে একটি বাড়ি পাওয়া গেছে প্রায় ৩০০ বর্গ মিটার এলাকা নিয়ে তৈরি । রাস্তাগুলি ছিল চওড়া, নর্দমাগুলি ছিল ঢাকা দেওয়া । প্রতিটি বাড়িতে উন্নত জল নিকাশি ব্যবস্থা ছিল । উঁচু এলাকা গুলিতে বড়ো বড়ো বাড়ি তৈরি করা হত । নিচু এলাকায় থাকত ছোটো ছোটো বাড়ি । রাস্তার ধারে জলের কুয়ো ছিল । প্রায় বাড়িতে শৌচাগারের ব্যবস্থা ছিল । একতলা, দোতলা বাড়ি গুলি পড়া ইটের তৈরি । প্রত্যেক বাড়ির ছোটো নালা বড়ো নর্দমায় গিয়ে পড়েছে ।


 নদীর তীরবর্তী জমি ছিল উর্বর, আবার জলসেচের সুবিধা পাওয়া যায় । তাই চাষের কাজের সুবিধার জন্য এখানের অধিবাসীরা নদীর তীরে বসবাস করতেন । নগরের বাইরে গ্রামীণ এলাকায় কৃষিজীবী মানুষরা বাস করতেন ।  গ্রামে যব, গম, সরষে, নানা প্রকারের ডাল ও ধানের চাষ হত । তবে, ধানের ফলন সব জায়গায় হত কিনা এর প্রমাণ পাওয়া যায়না ।  এছাড়াও তিল, তুলোর চাষ করা হত । কৃষিকাজ ছাড়া এখানে পশু পালন করা হত । প্রধান পশু ছিল – ভেড়া, ছাগল, ষাঁড়, উট ইত্যাদি । ঘোড়ার ব্যবহার তাঁরা জানতোনা বলে মনে করা হয় । কৃষির পাশাপাশি এখানকার মানুষরা যে বাণিজ্য করত তার প্রমাণ আমরা পাই, মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া হরপ্পায় তৈরি তেইশটি সিলমোহর থেকে । এরফলে আমরা জানতে পারি যে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল । আবার মেসোপটেমিয়ার একটি সিলমোহর এখানে পাওয়া গেছে । তাছাড়াও ইরান, তুর্কমেনিস্তানে হরপ্পার শিল্পদ্রব্যের খোঁজ পাওয়া গেছে । তাঁরা সাধারণত স্থলপথে ও জলপথে বাণিজ্য করত । বিদেশ থেকে আমদানি করা হত দামি পাথর, হাতির দাঁত, চিরুনি, সোনা, তামা, রুপো । আর রপ্তানি করা হত তেল, পশম, ময়দা ও বার্লি জাতীয় দ্রব্য ।

 যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য হরপ্পার অধিবাসীরা পশুর টানা গাড়ি, নৌকা ও জাহাজের ব্যবহার করত । পশু হিসাবে গাধা, বলদ, উঠ ইত্যাদি ব্যবহার হত ।  বলদের ব্যবহার গাড়ি টানার জন্য ব্যবহার বেশি হত । নানা রকম চাকার গাড়ির ব্যবহার হত । গাড়ির পাশাপাশি নৌকা ব্যবহার হত, কারণ – নদীপথে যাতায়াতের সময় অনেক কম লাগত । পালতোলা নৌকার ব্যবহার হত, যাতে হাওয়া ও স্রোতের সাহায্যে সহজে যাতায়াত করা যেত । যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক বেশি নদীর ওপর নির্ভর করত ।

 অনেক কারিগরি শিল্পের বিকাশ এখানে ঘটেছিল । নানা ধরণের বাসনপত্র, বাটালি, ছুরি, কুঠার, ইত্যাদি বানাত । এখানের মানুষরা লোহার ব্যবহার জানত না । পাথর ও ধাতু দিয় বিভিন্ন জিনিস তাঁরা বানাত । কাঁসা, তামা, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি ব্যবহার করতো । মাটির পাত্র যেমন – থালা, বাটি, জালা ইত্যাদি তৈরি করতো । মাটির পাত্র তৈরি করার পর আগুনে পুড়িয়ে নানা নকসা তৈরি করতো । মাটি পুড়িয়ে নারীমূর্তি, পশুপাখির মূর্তি ইত্যাদি বানাত । অনেক রকম মালা ব্যবহার হত । তাঁরা সোনা, তামা, শাঁখ, হাতির দাঁত, নীলচে লাজুলি পাথর মালা ও গয়না হিসাবে ব্যবহার করতো ।

 হরপ্পার লিপিগুলি ঠিকমত পড়া যায়নি । তাই এর থেকে তেমন কিছু জানা যায়না । লিপিগুলি সাংকেতিক ভাবে ছিল, তাতে ৩৭৫ থেকে ৪০০ টির মত চিহ্ন রয়েছে । এই লিপিগুলি লেখা ডান দিক থেকে বাম দিকে । ছোটো ছোটো চিহ্ন গুলিকে সংখ্যা বলে মনে করা হয় । তামার ফলক, সিলমোহরের উপর হরপ্পার লিপি পাওয়া গেছে । অনুমান করা হয় দ্রাবিড় ভাষার সাথে এর মিল রয়েছে । যে সিলমোহর এখানে পাওয়া গেছে সেগুলি নরম পাথর কেটে তৈরি করা । সিলমোহরে একটি এক শিং ওয়ালা পশুর মূর্তির ছাপ ও লিপির ব্যবহার দেখা যায় । এছাড়াও মানুষ, গাছ, ষাঁড়, জ্যামিতিক নকসা দেওয়া সিলমোহর পাওয়া গেছে । এগুলিতে সাদা জিনিস মাখিয়ে পোড়ানো হত ।

 
  হরপ্পায় অনেক নারী মূর্তি পাওয়া গেছে, এরফলে মনে করা হয় যে এখানে মাতৃ পূজার প্রচলন ছিল । একটি যোগী পুরুষের মূর্তি পাওয়া গেছে । এর চারপাশে রয়েছে বাঘ, গণ্ডার ইত্যাদি জন্তু । অনেকে একে আদি পশুপতি শিব বলেন । এক শিং ওয়ালা কাল্পনিক পশুর মূর্তির পূজা হত । ধর্মীয় কাজে এখানে জলের ব্যবহার হত ।

হরপ্পা সভ্যতা বিভিন্ন কারণে অবনতি হয়েছিল । অতিরিক্ত গাছ কাটার ফলে বৃষ্টিপাত কমে যায়, ফলে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় । আবহাওয়া পরিবর্তনের হয়ে শুষ্ক জলবায়ু দেখা যায় । অনেকে মনে করেন যে সিন্ধু নদীর বন্যার ফলে এই সভ্যতা অবনতি হয় । পাচিলে কাদার চিহ্ন পাওয়া গেছে । বন্যার ফলে এই অবস্থা বলে অনুমান করা হয় । বাণিজ্যে ভাটা পড়ার জন্য নগর ও শাসন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায় । অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয় । এছাড়াও আরও বিভিন্ন কারণে হরপ্পা সভ্যতা দুর্বল হয়ে পড়ে ।

 আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে ও আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নীচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে দিতে দয়া করে শেয়ার করুন । ইতিহাস বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে ইতিহাস লেখাটির উপর ক্লিক করুন । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ 
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।



২টি মন্তব্য:

ধন্যবাদ

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷