রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২০

ভারতের একটি নিষিদ্ধ দ্বীপ কোন টি ও কেন ?.


ভ্রমণপিপাসু ও দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা মানুষরা সব সময়েই নতুন, অজানা, রহস্যময় বা নিষিদ্ধ কোন স্থানের নাম শুনলেই সেই রহস্য তাদেরকে আকৃষ্ট করে এবং তারা অজানাকে জানতে ও রহস্যকে ভেদ করতে চান । সেরকম একটি রহস্যময়য় স্থান রয়েছে আমাদের ভারতের মধ্যে । সেটি হল একটি নিষিদ্ধ দ্বীপ - নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপ । নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপটি আপনার কাছ থেকে খুব বেশি দূরে নয় । কারণ আমাদের প্রিয় বঙ্গোপসাগরের বুকে এই দ্বীপটি অবস্থিত । আমরা অনেকেই এর অস্তিত্বের কথা সঠিক ভাবে জানিনা । কারন, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম এই দ্বীপ এবং এর অধিবাসীদের সম্পর্কে তেমন কোনো ইতিহাস কারো জানা নেই । পৃথিবীর অধিবাসী হয়েও তারা সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের বুকের ছোট্ট এক নির্জন দ্বীপে ।

 চতুর্ভুজ আকারের দ্বীপটির আয়তন ৫৯.৬৭ বর্গ কিলোমিটার । সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ১২২ মিটার । দ্বীপে রয়েছে ঘন সবুজ বনভূমি । দ্বীপটি প্রবাল প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত । দ্বীপের চারপাশের প্রবাল প্রাচীরগুলো ৪০০ থেকে ১২৯০ মিটার পর্যন্ত প্রসারিত । পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । স্মিথ আইল্যান্ডের ২০ মাইল পশ্চিমে এই দ্বীপটির অবস্থান । ১৯৭০ সালে ভারত সরকার এই দ্বীপটিকে নিজেদের বলে ঘোষণা করে । সেন্টিনেলদের বাসস্থল এই দ্বীপটি ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একটি অংশ । ভৌগোলিক অবস্থান হিসেবে এবং কাগজে কলমে দ্বীপটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত । কিন্তু দ্বীপের ওপর ভারতের আদৌ কোনো কর্তৃত্ব নেই । বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে সমুদ্রের তলদেশ থেকে মহাকাশ পর্যন্ত অনেক কিছুই মানুষের জানা হয়ে গেলেও এই দ্বীপটি এখনো মানুষের অজানা থেকে গেছে । বিশ্ববাসীর কাছে জানার কোনো সুযোগ নেই যে - দ্বীপটির লোকজন কেমন ও তারা কিভাবে জীবন-যাপন করে । কারণ, তারা কখনই বহির্বিশ্বের মানুষের সঙ্গে মিশতে চায়না । 

 নৃবিজ্ঞানীদের মতে সেন্টিনেলিসরা এই দ্বীপটিতে সেই প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকে বসবাস করে আসছে । নৃবিজ্ঞানীদের মতে এই দ্বীপটি ৬০ হাজার বছরের বেশি প্রাচীন । ৬০ হাজার বছর ধরে দ্বীপটির বাসিন্দারা নিজেদের মতো করেই এখানে টিকে আছে । তাদের ধারণা, সেন্টিনেলিসদের আদিপুরুষরা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপটিতে এসেছিল ।  বিশেষজ্ঞদের মতে - সেন্টিনেলিসরাই হল বিশ্বের একমাত্র নৃগোষ্ঠী যারা আধুনিক বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ রূপে দূরে রয়েছে । যাদের কাছে এখন পৌঁছাতে পারেনি আধুনিক সভ্যতা । এখানে কেউ ভুল করে বা  দুর্ঘটনার কারণে, বা পথ হারিয়ে কেউ  প্রবেশ করলে তাদেরকে হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে । এমনকি হেলিকপ্টারও সেখানে ল্যান্ড করতে সাহস পায় না । বাইরের থেকে আশা মানুষকে তারা তাদের রাজ্যে প্রবেশের কোনা অনুমতি দেয় না । প্রতিবার অনুপ্রবেশকারীরা তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছে ও মৃত্যু হয়েছে । এ কারণে কেউ সফলভাবে এই দ্বীপে যেতে পারে না । অনেকবার চেষ্টা করেও দ্বীপটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারেনি ভারত সরকার । তাই এই দ্বীপটি এখনো বলতে গেলে অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে ।

 এই দ্বীপটির কথা আমরা প্রথম জানতে পারি বিখ্যাত ইতালিয় পর্যটক ও ব্যবসায়ী মার্কো পলোর বর্ণনা থেকে ।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি জাহাজ দ্বীপটির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় ১৭৭১ সালে সেখানে সৈকতে আলো দেখতে পায় । ১৯৬৭ সালে থেকেই ভারত সরকার সেন্টিনেলিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছিল । আদিম এই উপজাতির সঙ্গে সভ্য মানুষের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৮৮০ সালে । ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ এম ভি পোর্টম্যানের নেতৃত্বে একটি দল ওই দ্বীপে গিয়ে উপজাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন । ভারতীয় নৃতত্ত্ববিদ ত্রিলোক নাথ পণ্ডিতই প্রথমবারের মতো ১৯৯১ সালের ৪ জানুয়ারি দ্বীপটিতে নিজে গিয়ে সেন্টিনেলদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করেন । কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি । ১৯৯১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে মধুমালা চট্টোপাধ্যায় সেই দ্বীপটিতে গিয়েছিলেন সেন্টিনেলিসদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে । প্রথমে একটু বাধার সম্মুখীন হলেও আস্তে আস্তে তারা তাকে গ্রহণ করে নেয় । কিন্তু পরবর্তী কালে দ্বীপটিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর তিনি আর সেখানে যেতে পারেননি ।  ১৯৫৬ সালের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী উপজাতি সুরক্ষা আইনের বলে[ এই দ্বীপে ভ্রমণ এবং পাঁচ নটিক্যাল মাইলের (৯.২৬ কিমি) থেকে কাছাকাছি যে-কোন যোগাযোগের চেষ্টা নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।

 ১৯৭৫ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একজন চিত্রগ্রাহক তথ্যচিত্র বানানোর জন্য গিয়েছিলেন সেন্টিনেল দ্বীপে । উপজাতিদের বিষ মাখানো তীরের আঘাতে তিনি মারাত্মক ভাবে জখম হন । ২০০৬ সালে সেন্টিনেল তীরন্দাজরা তাঁদের দ্বীপে অনুপ্রবেশকারী দুজন জেলেকে তীর মেরে হত্যা করে মাটি চাপা দিয়ে দেয় । ২০১৮ সালের খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অভিলাষে সাতাশ বছর বয়সের এক মার্কিন ধর্মযাজক ওই নিষিদ্ধ দ্বীপে গিয়েছিলেন । তাঁকে তীর ছুড়ে হত্যা করেছিল সেন্টিনেলিজরা । যে সব মৎস্যজীবীর সহায়তায় এই তরুণ মার্কিন ধর্ম যাজক সেখানে পৌঁছেছিলেন তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে । ২০১৭ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নিয়ে কোনোরকম ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আপলোড করাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল ।
 
 বিশ্বের অন্য যেসব উপজাতি আছে, তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই উপজাতি । ধারণা করা হয় প্রস্তর যুগ থেকে এই দ্বীপে তাদের বসবাস চলে আসছে । তারা দেখতে কেমন, কি ধরনের জীবন-যাপনে অভ্যস্ত, বহির্বিশ্ব সম্পর্কে তারা কী ভাবে সে সম্পর্কেও কিছুই জানার সুযোগ নেই । তবে যেটুকু জানা যায়জাতিতে এরা সেন্টিনেলি । সেন্টিনেলিরা বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত আদিবাসী আন্দামানি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত । এখানের বাসিন্দাদের ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর আছে । এই কুড়েঘর গুলোর কোনো দেয়াল নেই, শুধু মাথার ওপর ছাউনিটি মাটি পর্যন্ত প্রসারিত করা । এখন পর্যন্ত এখানে কৃষিকাজ করার কোনা প্রমাণ পাওয়া যায় না । তাই এরা মূলত একটি শিকার-নির্ভর জাতি । শিকার করা ও বন্য লতাপাতা, সামুদ্রিক মাছ, প্রাণী ও দ্বীপের উদ্ভিদ হল সম্ভবত তাদের প্রধান খাদ্য । সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো আজও এরা হয়তো আগুন জ্বালাতে শেখেনি ।

 এদের ভাষার নাম দেওয়া হয়েছে সেন্টিনেলি ভাষা । ধারণা করা হয়, এটি আন্দামানি ভাষাগুলোর একটি । আন্দামানের আদিবাসী ওঙ্গেদের সঙ্গে এদের ভাষার কিছুটা মিল পাওয়া যায় । সেন্টিনেলিদের ধর্ম সম্পর্কে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনো ধারণাই পাওয়া যায় না । তাদের সংশ্লিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কেও তেমন জানা যায় না । এরা ধাতব সামগ্রী দিয়ে অল্প কিছু জিনিস বানাতে পারলেও ধাতু দিয়ে তেমন কিছু বানাতে পারে বলে মনে করা হয় না । এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে সেন্টিনেলীদের জনসংখ্যার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না । মনে করা হয় যে - দ্বীপটির লোকসংখ্যা ৫০ থেকে ৪০০ জনের মতো হতে পারে । সেন্টিনেলরা তাঁদের অঞ্চলে, তাঁদের সব বিষয়ে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে । এই দ্বীপে আজও পৌঁছাতে পারেনি পৃথিবীরর আধুনিকতার ছোঁয়া ।

 আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে বা আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্ট টি পৌঁছেদিতে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুণ । জানা অজানা বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে জানা অজানা লেখাটির উপর ক্লিক করুণ । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপনার ইমেল দিয়ে আমাদের ওয়েবসাইট টি সাবস্ক্রাইব করুন ।


আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ধন্যবাদ

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷