ভারতের জাতীর জনক মহাত্মা গান্ধীর বাংলা জীবনী .
মহাত্মা গান্ধী একজন অন্যতম ভারতীয় রাজনীতিবিদ, ভারতের
স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিদের একজন এবং
প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন । ১৮৬৯ সালের
২রা অক্টোবর ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় গুজরাত প্রাদেশিক এলাকা পোর বন্দরে
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জন্ম গ্রহণ করেন । তার পিতা করমচাঁদ গান্ধী ও মা পুতলিবা
করমচাঁদের চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন । পুতলিবা প্রণামী বৈষ্ণব গোষ্ঠীর ছিলেন । তাঁর মা
ছিলেন একজন অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা, যিনি পুত্রের মধ্যে দৃঢ় হিন্দু নৈতিকতার সঞ্চার করেছিলেন । ধার্মিক
মায়ের সাথে এবং গুজরাটের জৈন প্রভাবিত পরিবেশে থেকে
গান্ধী ছোটবেলা থেকেই জীবের প্রতি অহিংসা, নিরামিষ ভোজন,
আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাসে থাকা, বিভিন্ন
ধর্মাবলম্বী ও সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয় শিখতে শুরু করেন । মানব
হিতৈষী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী সবার কাছে পরিচিত ছিলেন মহাত্মা এবং বাপু নামে ।
মহাত্মা গান্ধী তার ছোটবেলায় পোর বন্দর ও রাজকোটের ছাত্র ছিলেন । গুজরাটের ভবনগরের সামালদাস কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন । ১৮৮৩ সালে মাত্র ১৪
বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধী বাবা মায়ের পছন্দে কস্তুরবা মাখাঞ্জীকে বিয়ে করেন । তার
পরিবারের ইচ্ছা ছিল তাকে আইনজীবী করা । সে জন্য ১৮ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালের ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে পড়তে যান ।
তিনি লন্ডনের গুটি কয়েক নিরামিষভোজী খাবারের দোকানের একটিতে নিয়মিত যেতেন ।
লন্ডনে পড়তে যাবার আগে গান্ধী তার মা পুতলিবাই এবং চাচা বেচারজির কাছে প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি মাংস খাওয়া, মদ্যপান এবং নারী সঙ্গ থেকে বিরত থাকবেন । তিনি মাংস, মদ এবং উচ্ছৃঙ্খলতা ত্যাগ করার হিন্দু নৈতিক উপদেশ পালন করেন । গান্ধী এ সময় অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গলাভ করেন এবং লন্ডন ভেজিটেরিয়ান সোসাইটির চেয়ারম্যান ড. জোসেফ ওল্ডফিল্ড এর বন্ধু হয়ে ওঠেন । গান্ধী হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, ইসলামসহ অন্যান্য ধর্ম এবং বিভিন্ন রীতি সম্পর্কে পড়াশোনা করেন । লন্ডন থেকে ফেরার পর গান্ধী নিরামিষ খাবার ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করেন । গান্ধীর মতে, নিরামিষ শুধু শরীরের চাহিদাই মেটাবে না, এটি মাংসের প্রয়োজন মিটানোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যও পূরণ করবে, যা সবজি ও ফলের চেয়ে মূল্যবান ।
একজন শিক্ষিত
ব্রিটিশ আইনজীবী হিসেবে দক্ষিণ
আফ্রিকায় নিপীড়িত ভারতীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের অধিকার আদায়ের
আন্দোলনে গান্ধী প্রথম তাঁর অহিংস শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের মতাদর্শ প্রয়োগ
করেন । গান্ধীজী একজন আইনজীবী হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান । দক্ষিণ আফ্রিকা
গান্ধীর জীবনকে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন করে দেয় । প্রথম শ্রেণীর বৈধ টিকিট থাকা
সত্ত্বেও একটি ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরা থেকে তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় তাকে নেমে
যেতে বাধ্য করা হয় । এমন কি তাকে হোটেল থেকেও বহিষ্কার করা হয় । এখানে তিনি
ভারতীয় ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হন । ১৮৯৪ সালে গান্ধী নাটাল ইন্ডিয়ান
কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা
করেন । এই সংগঠনের মাধ্যমে সেখানকার ভারতীয়দেরকে রাজনৈতিক ভাবে সংঘবদ্ধ করেন ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের ভোটাধিকার ছিল না । এই অধিকার আদায়ের বিল উত্থাপনের
জন্য তিনি আরও কিছুদিন দেশটিতে থেকে যান ।
১৯১৫ সালের ৯ই জানুয়ারি
গান্ধী ভারতে ফিরে আসেন । এইজন্য ওই দিনটিকে প্রবাসী ভারতীয় দিবস হিসাবে
পালন করা হয় । গান্ধী ভারতে প্রথম সাফল্য অর্জন করেন ১৯১৮ সালের চম্পারন বিক্ষোভ
এবং খেদা সত্যাগ্রহের মাধ্যমে । সে সময় মারাত্মক দুর্ভিক্ষের মাঝে ব্রিটিশরা একটি
শোষণমূলক কর চালু করেন এবং তা বাড়ানোর চেষ্টা করেন । এতে পরিস্থিতি প্রচণ্ড
অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে । তিনি প্রতিবাদ করায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রদেশ ছেড়ে
যেতে নির্দেশ দেয়া হয় । অন্যায়ের বিরুদ্ধে গান্ধীর অস্ত্র ছিল অসহযোগ এবং
শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ । এই ঘটনার ফলে জেলের বাইরে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়ে
বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন । পুলিশ স্টেশন ও আদালতে এসে তারা গান্ধীর মুক্তি দাবি করতে
থাকে । আদালত নীরবে মেনে নিয়ে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন । গান্ধী জমিদারদের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত বিক্ষোভ
ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন এবং জমিদাররা ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে কৃষকদের আরও
বেশি ক্ষতিপূরণ এবং চাষাবাদের বিষয়ে তাদের আরো নিয়ন্ত্রণ প্রদানে রাজি হয় । গান্ধী
সেখানে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার বহু দিনের সমর্থক ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের
একত্রিত করেন ।
গান্ধী ভারতে শিখদের তীর্থস্থান অমৃতসরে এক
গণহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করলেন ।
পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে সাধারণ মানুষের উপরে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৯১৯ সালে সংগঠিত ভাবে হত্যাকাণ্ড
চালায় । ব্রিটিশদের গুলিতে
প্রায় ৪০০ মানুষ প্রাণ হারায়, আর আহত
হয় ১৩০০ মানুষ । গান্ধী তার অহিংস নীতির পরিবর্ধন করেন স্বদেশী নীতি যোগ করে ।
স্বদেশী নীতি মতে সকল বিদেশী পণ্য বিশেষত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করতে হবে । তিনি
ব্রিটিশ শাসকদের সাথে অসহযোগিতার ডাক দেন, যার সাথে সাথে ব্রিটিশ
পণ্য বর্জনেরও কর্মসূচি পালন করেন । তাঁর অহিংস আন্দোলন-বিক্ষোভের ডাক সব শ্রেণী
এবং ধর্মের মানুষের দ্বারা সাদরে সমাদৃত হয়েছিল । ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ গান্ধীকে
রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে এনে গ্রেপ্তার করেন এবং দুই বছরের জন্য তাকে কারাবন্দী
করার আদেশ দেওয়া হয় ।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মহাত্মা গান্ধী ভারতীয়
জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাহী দায়িত্বপ্রাপ্ত
হন । ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে
আসার পর গান্ধী ভারতব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারী স্বাধীনতা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে
ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ, জাতির অর্থনৈতিক সচ্ছলতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার শুরু করেন । তাছাড়াও তিনি
অস্পৃশ্যতা, মদপান, অবজ্ঞা এবং দরিদ্রতার
বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন । স্বরাজ পার্টি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মাঝে
বাধা দূর করতে চেষ্টা করেন । গান্ধী
কলকাতা কংগ্রেসে ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা
দেওয়ার দাবি জানান, অন্যথায় নতুন অহিংস নীতির পাশাপাশি পূর্ণ
স্বাধীনতার হুমকি দেন । ১৯৩০ সালে গান্ধী ভারতীয়দের লবণ করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে
৪০০ কিলোমিটার বা ২৪৮ মাইল দীর্ঘ ডান্ডি লবণ আন্দোলন করেন । তাঁর সাথে হাজার হাজার
ভারতীয় হেঁটে সাগরের তীরের পৌঁছান । এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তার অন্যতম
সফল প্রয়াস ।
১৯৩১ সালে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে গোলটেবিল
আলোচনায় অংশ নিতে লন্ডন সফরে যান গান্ধী । গান্ধীকে গোল টেবিল বৈঠকের জন্য লন্ডনে
আমন্ত্রণ জানান হয় । সেখানে তিনি একাই কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করেন । দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে দেয়া, গান্ধীর আন্দোলনের
লক্ষ্যগুলো বাস্তব হয়ে ওঠে । ১৯৪৭ সালে অনেক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রিয়তম
দেশে স্বাধীনতা আসে ।
মহাত্মা গান্ধী সমস্ত পরিস্থিতিতেই অহিংস মতবাদ এবং সত্যের
ব্যাপারে অটল থেকেছেন । তিনি সাধারণ নিরামিষ খাবার খেতেন । শেষ জীবনে ফলমূলই বেশি খেতেন । নিরামিষভোজী এর ধারণা হিন্দু ও
জৈন ধর্মে গভীরভাবে বিদ্যমান । গান্ধী প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন যে, সামাজিক কাজে নিয়োজিত একজন ব্যক্তি অবশ্যই সাধারণ জীবন যাপন
করবে । তিনি সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং একটি স্বায়ত্তশাসিত আশ্রম
প্রতিষ্ঠা করেন । গান্ধী স্বল্প বসনের মানুষ ছিলেন । আন্তর্জাতিক বৈঠকেও তিনি এই পোশাকে উপস্থিত হতেন । নিজের
পরিধেয় কাপড় তিনি নিজেই চরকায় বুনতেন । তাঁর জীবনাচরণে ছিল অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে ফেলা, সাদামাটা জীবন-যাপন গ্রহণ এবং নিজের কাপড়
নিজে ধোয়া । গান্ধী হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার সারা জীবন ধরে হিন্দু
ধর্মের চর্চা করেন । হিন্দু ধর্ম থেকেই তিনি তার অধিকাংশ আদর্শ গ্রহণ করেন । তিনি সকল ধর্মকে সমানভাবে বিবেচনা করতেন । গান্ধী বিশ্বাস
করতেন, প্রতিটি ধর্মের মূলে আছে সত্য ও প্রেম ।
গান্ধী পত্র-পত্রিকায় প্রচুর চিঠি লিখতেন । প্রায়
প্রতিদিনই কোন না কোন পত্রিকায় তার চিঠি প্রকাশিত হতো । গান্ধী গুজরাটি ভাষায় "ভগবত গীতা"র উপর ধারাভাষ্য
লেখেন । গুজরাটি পাণ্ডুলিপিটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন মহাদেব দাসী । গান্ধীর
বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে । এগুলি হল - সত্যের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার গল্প (The Story of My Experiments with Truth), দক্ষিণ
আফ্রিকার সংগ্রাম নিয়ে “দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ (Satyagraha
in South Africa), স্বাধীকার বিষয়ে মেনিফেস্টো “হিন্দি স্বরাজ” ইত্যাদি । বহুমুখী লেখায় পারদর্শী মহাত্মা গান্ধী সম্পাদনা করেছেন
গুজরাটি, হিন্দি ও
ইংরেজি ভাষার পত্রিকা ‘হরিজন’ । ১৯৬০ দশকে
ভারত সরকার গান্ধীর রচনাবলি দ্য কালেক্টেড ওয়ার্ক অব মহাত্মা গান্ধী প্রকাশ করে ।
বইটি শতাধিক খণ্ডে প্রকাশিত হয় ।
ভারত সরকার মহাত্মা গান্ধীকে ভারতের জাতির জনক
হিসেবে ঘোষণা করেছে । ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহান এই নেতার মৃত্যু হয় । একটি
পার্থনা সভায় যোগ দেওয়ার জন্য বেরিয়ে ছিলেন । নাথুরাম গডসে ছিলেন একজন হিন্দু
মৌলবাদী, সে গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করে । শান্তির জন্য বিশ্বজুড়ে সুবিদিত এক মহান
ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে সারাবিশ্ব থেকে অসংখ্য মানুষ সমবেত হন শোক প্রকাশের জন্য । গান্ধীর
ইচ্ছানুযায়ী, তার দেহ-ভস্ম বিশ্বের বেশ
কয়েকটি প্রধান নদীতে ডুবানো হয় । তার দেহ-ভস্ম মহাত্মা গান্ধী বিশ্ব শান্তি সৌধে
একটি হাজার বছরের পুরনো চৈনিক পাথরের পাত্রে সংরক্ষণ করা হয় ।
আমাদের লেখা
আপনার কেমন লাগছে বা আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার
বন্ধুদের কাছে পোস্ট টি পৌঁছেদিতে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুণ । জীবনী বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে জীবনী লেখাটির উপর ক্লিক করুণ । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে
অনেক ধন্যবাদ । আপনার ইমেল দিয়ে আমাদের
ওয়েবসাইট টি সাবস্ক্রাইব করুন ।
আমাদের আরও পোস্ট -
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
ধন্যবাদ
মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷