রবিবার, ৫ এপ্রিল, ২০২০

বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার বাংলা জীবনী.


 বেগম রোকেয়া একজন অসাধারণ মহিলা । তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, সমাজসংস্কারক এবং নারী জাগরণ ও নারীর অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ তিনি বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী । যার কর্ম প্রচেষ্টা বেশ গ্রহণ যোগ্য ভাবে পশ্চিমবঙ্গের মহিলা শিক্ষার অবস্থা বদলে দিয়েছিল । তাঁর পুর নাম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন । রোকেয়া ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার ও মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী পিতা ও মাতার দিক থেকে বেগম রোকেয়া উচ্চবংশীয় এবং জমিদার শ্রেণীভুক্ত ছিলেন । রোকেয়ারা ছিলেন তিন বোন ও তিন ভাই ।


 তিনি ছিলেন প্রথম প্রথা ভঙ্গকারী, যিনি দরিদ্র মুসলিম মহিলাদের জন্য পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন । তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে – মহিলাদের আধুনিক শিক্ষা সমাজের অগ্রগতির জন্য অবশ্যই প্রয়োজন । তিনি পিছিয়ে পরা মহিলাদের প্রতি দয়ালু, হত দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন । তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের গৃহের অর্গলমুক্ত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ ছিল না বেগম রোকেয়ার পিতা আবু আলী হায়দার সাবের আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল ।
 রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম । রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসাও ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী বেগম রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনে বড় দু’ভাই ও বোন করিমুন্নেসার যথেষ্ট অবদান ছিল । বেগম রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের ছিলেন আধুনিক মনাতিনি চাননি তাঁর বোনেরা পিছিয়ে থাকুক । তিনি রোকেয়া ও করিমুন্নেসাকে ঘরেই গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখান । বড় ভাই-বোনদের সমর্থন ও সহায়তায় তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি এবং আরবি ভাষা আয়ত্ত করেন । বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের সহযোগিতায় গভীর রাত পর্যন্ত মোমবাতির ক্ষীণ আলোতে পড়াশোনা করেছেন
 তৎকালীন মুসলিম সমাজে ছিল কঠোর পর্দা ব্যবস্থা । বাড়ির মেয়েরা পরপুরুষ তো দূরে থাক, অনাত্মীয় নারীদের সামনেও নিজেদের চেহারা দেখাতে পারতো না । তৎকালীন সমাজব্যবস্থা অনুসারে রোকেয়া ও তাঁর বোনদের কখনোই বাড়ির বাইরে পড়াশুনা করার জন্য পাঠানো হয়নি । তিনি শিক্ষার অভাবকে নারী পশ্চাৎপদতার কারণ বলেছেন । নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, নারীকে মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই শিক্ষার মাধ্যমে নারী সমাজকে আধুনিক প্রগতিশীল করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য ।

 ১৮৯৮ সালে রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে । তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সমাজ সচেতন, কু-সংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্নতাঁর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায় । যার হাত ধরেই বেগম রোকেয়া পেয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ, নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করার অফুরন্ত সুযোগ । বিয়ের পর রোকেয়ার আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ালেখা পুরো দমে শুরু হয় এবং সাহিত্যচর্চার পথটা তাঁর জন্য খুলে যায় । স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন । রোকেয়ার বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয় নি । ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াত হোসেন মারা যান । বেগম রোকেয়া বৈধব্য জীবন বেছে নেন এবং সমাজ সেবামূলক কাজ ও সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন ।
 ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর পর বেগম রোকেয়া মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেও হাল ছাড়েননি । স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ রোকেয়া নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর স্বামীর প্রদত্ত অর্থে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে তিনি ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন । সেটি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে তিনি নব পর্যায়ে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন । সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল ১৯৩০ খ্রিঃ বেগম রোকেয়ার অক্লান্ত পরিশ্রমে একটি উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় । কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে পুরুষ শাসিত সমাজের সমাজপতি ও রক্ষণশীল গোঁড়াপন্থি কিছু লোক নানা বিঘ্ন সৃষ্টি করে ।  এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখার জন্য বেগম রোকেয়া তার নিজস্ব জমিদারি থেকে প্রাপ্ত আয়ের বহুলাংশ স্কুলের জন্য ব্যয় করেন ।
 ১৯১৬ সালে কলকাতায় ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি যেখানে বিধবা নারীদের কর্মসংস্থান, দরিদ্র অসহায় বালিকাদের শিক্ষা, বিয়ের ব্যবস্থা, দুঃস্থ মহিলাদের কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ, নিরক্ষরদের অক্ষর জ্ঞান দান, বস্তিবাসী মহিলাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন । বেগম রোকেয়ার আত্মত্যাগ ও নিরলস প্রচেষ্টার ফলে বাংলার মুসলিম নারীজাগরণ ও মুক্তির পথ প্রশস্ত হয় । ১৯১৭ সালে ওই সংগঠনের ৫০ জন মহিলা সদস্যের উপস্থিতিতে ১৫ এপ্রিল প্রথম বার্ষিক সম্মেলন করে একটা যুগান্তকারী ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন
 মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষাবিস্তার, নারীমুক্তি ও প্রগতির আন্দোলন ছাড়াও বেগম রোকেয়া সাহিত্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন ।  ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও শ্লে­ষাত্মক রচনায় রোকেয়ার স্টাইল ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্য মন্ডিত । প্রবন্ধগ্রন্থে রোকেয়া নারী-পুরুষের সমকক্ষতার যুক্তি দিয়ে নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় আহ্বান জানিয়েছেন । ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্য জগতে তার অবদান রাখা শুরু হয় । এরপর একে একে লিখে ফেলেন মতিচূর-এর প্রবন্ধগুলো এবং সুলতানার স্বপ্ন-এর মতো নারীবাদী বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ।
 তার প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গ সমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন । তিনি পুরুষতান্ত্রিক কিংবা নারী তান্ত্রিক সমাজ গড়তে চাননি । তিনি চেয়েছিলেন সমাজে নারী ও পুরুষ যাতে একসাথে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে বাঁচে । সমাজের অর্ধেক অংশকে বাদ দিলে কখনোই রাষ্ট্রের উন্নতি হবে না । তাই  তিনি ছিলেন সমতায় বিশ্বাসী । নারীশিক্ষার প্রসারে বেগম রোকেয়া আমৃত্যু কাজ করে গিয়েছেন । নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, ভোটাধিকারের জন্য লড়াই শুরু করেছিলেন বেগম রোকেয়া ।

 বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাসে বেগম রোকেয়ার অবদান চিরঅম্লান হয়ে থাকবে নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং আলোর দিশারী বেগম রোকেয়ার জীবনকাল ছিল মাত্র বায়ান্ন বছর ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে বেগম রোকেয়া কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন । বেগম রোকেয়ার কর্ম ও আদর্শ উদযাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর ৯ই ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস উদযাপন করে । বেগম রোকেয়া আজ আমাদের মাঝে নেই । কিন্তু তাঁর আদর্শ যাতে আমরা বুকে লালন করে চলতে পারি, নিজেদের কাছে আমরা সেই প্রতিজ্ঞা করবো ।
 আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে বা আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্ট টি পৌঁছেদিতে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুণ । জীবনী বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে জীবনী লেখাটির উপর ক্লিক করুণ । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । আপনার ইমেল দিয়ে আমাদের ওয়েবসাইট টি সাবস্ক্রাইব করুন । 

আমাদের আর পোস্ট - 
শিক্ষককুলের রবি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের বাংলা জীবনী.
ভারতের বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের বাংলা জীবনী.
দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলা জীবনী .
ভারতের মিসাইল ম্যান ডঃ এ. পি. জে আব্দুল কালামের বাংলা জীবনী
বিশ্বকবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা জীবনী
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ধন্যবাদ

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷