সোমবার, ২ মার্চ, ২০২০

দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলা জীবনী .


  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বর্তমান মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতার নাম ভগবতী দেবী । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আসল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর হল তাঁর উপাধি ঊন বিংশ শতকের এক বিরাট পণ্ডিত মহান সমাজ-সংস্কারক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর  শৈশব কাল থেকে তিনি ছিলেন খুব মেধাবী । পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয় মাত্র নয় বছর বয়সে পথের ধারে মাইল স্টোনে ইংরেজি সংখ্যা দেখে তিনি চিনে নিতে শিখেছিলেন । এই ঘটনা তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও প্রতিভার পরিচয় প্রদান করে ।

 বিদ্যাসাগর মশাই অল্প বয়সে বাবার সাথে কলকাতায় চলে আসেন অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে তিনি কলকাতায় লেখাপড়া শিখেছিলেন । ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়  কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তিনি পড়াশুনা করেনতিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন তেলের অভাবে রাতে রাস্তার আলোর নিচে তিনি পড়াশোনা করতেন । দিনের বেলা বিভিন্ন কাজ যেমন – বাজার করা, রান্না করা, বাসন মাজা ইত্যাদি করতে হত । এতো কিছু কাজ করার পরে তিনি কলেজে পড়তে যেতেন । এতো কষ্টের পরে তিনি পরীক্ষায় ভাল ফল করতেন । শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য সাফল্যের জন্য স্কলারশিপ অর্জন করেছিলেন ১৮৪১ সালে তিনি সংস্কৃত নিয়ে পাস করেন মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন ।

 ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করার অল্প পরেই তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান পণ্ডিতের পদ লাভ করেন ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরের মাসে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি কলেজের অনেক সংস্কার করেন তিনি কলেজে পড়ার জন্যে নামেমাত্র বেতন চালু করেন এবং প্রতিপদ ও অষ্টমীর বদলে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি চালু করেন ইংরেজি ভাষা শেখাকে তিনি বাধ্যতামূলক করেন এবং ইংরেজি বিভাগকে উন্নত করেন বাংলা শিক্ষার ওপরও তিনি জোরসংস্কৃত-শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি সংস্কৃত কলেজে -ব্রাহ্মণ শ্রেণির ছাত্রদের ভর্তির ব্যবস্থা করেন
 বিদ্যাসাগর ছিলেন সাহসী, ধার্মিক ও সত্যবাদী । সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষ তাঁকে সম্মান করতেন ।  ভারতের বড়লাট ও ছোটলাট তাঁকে রাজার মত সম্মান করতেন । তিনি এতো বড় পণ্ডিত হলেও তাঁর পোশাক ছিল নিতান্ত সাধারণ । একটি চাদর, পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি, এই ছিল তাঁর পোশাক শিক্ষা সংস্কার, আধুনিক শিক্ষার প্রচলন, নারী শিশুশিক্ষার বিস্তার ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে বিদ্যাসাগরের সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন । স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি রাম গোপাল ঘোষ, রাধাকান্ত দেব প্রমুখ ব্যক্তিদের সাহায্য সহযোগিতা পানতিনি বুঝেছিলেন, নারী জাতি অনগ্রসর কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে থাকলে সমাজ পিছিয়ে থাকবে   তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় ’ (বর্তমান বেথুন স্কুল) স্থাপন করা
 বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন শিক্ষাব্রতী সমাজসংস্কারক ব্যক্তি বাংলার সংস্কার আন্দোলন, বিশেষত নারী কল্যাণের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান চির স্বীকার্য  বহুবিবাহ, বাল্য-বিবাহ প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি প্রবল জনমত গড়ে তোলেন বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ ছিল তার বিশেষ কীর্তি সেই সময় মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হত । এইসব মেয়েদের মধ্যে অনেকের উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগে স্বামীর মৃত্যু হত । এরফলে তারা অল্প বয়সে বিধবা হয়ে যেত । এইসব অল্প বয়সী মেয়েদের জন্য বিদ্যাসাগর মশাইয়ের প্রাণ কাঁদত । প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার গোঁড়ামির অপসারণ করে তিনি সমাজ জীবনকে কলুষমুক্ত করতে চেয়ে ছিলেন সারাজীবন ধরে তিনি সমাজ-সংস্কারে ব্রতী থাকেন

 তিনি বিভিন্ন বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়ে শাস্ত্রমতে প্রমাণ করলেন যে – হিন্দু শাস্ত্রে বিধবা বিবাহে কোন বাধা নেই ।  হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহের স্বপক্ষে জোর বক্তব্য রাখেন  সমাজের ধনী, প্রতিপত্তিশালী, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বিরোধিতা সত্ত্বেও হিন্দু বিধবা বিবাহ চালু করেন । তাঁর প্রচেষ্টায় গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে এক আইন প্রণয়ন করে বিধবা বিবাহকে আইন সিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন চালু করে সাফল্যে লাভ করেছিলেন বরাবর মানুষের দুর্দশায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সরকারি আইন প্রণয়ন করে কন্যার বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন দশ বছর নির্ধারিত করা হয়

 বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের শব্দ-সাযুজ্য আবিষ্কার, বাক্য-কাঠামো সংস্কার, কর্তা ও ক্রিয়াপদ এবং ক্রিয়া ও কর্মের মধ্যে যথাযথ অন্বয় স্থাপন করে বাংলা গদ্যকে মাধুর্য দান করেন  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা গদ্যকে সরস মধুর করে সাধারণের হৃদয় বেদ্য করে তুলেছিলেন এজন্য তিনি 'বাংলা গদ্যের জনক' নামে খ্যাত অবশ্য তিনি একই গদ্যরীতিতে তাঁর সব রচনা লেখেননি, তিনি পাঠ্যপুস্তক যে-রীতিতে লিখেছেন, সাহিত্য রচনা করেছেন তা থেকে ভিন্ন ভঙ্গিতে তিনি কেবল পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে নয়, বরং তাঁর অন্যান্য রচনা দিয়েও বাংলা গদ্যের সংস্কার এবং তার মান উন্নত করতে সমর্থ হয়েছিলেন

 সে যুগে বাঙালি ছাত্রদের উপযোগী কোনও পাঠ্যপুস্তক ছিল না শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশ করা শিক্ষাবিস্তারের জন্য তিনি বর্ণপরিচয়, কথামালা, ঋজু পাঠ, আখ্যান মঞ্জরী, বোধোদয় প্রভৃতি পুস্তক লেখেন তাঁর বর্ণপরিচয়ের মান এতো উন্নত ছিল যে, প্রকাশের পর থেকে অর্ধ শতাব্দী পর্যন্ত এই গ্রন্থ বঙ্গদেশের সবার জন্যে পাঠ্য ছিল দেড়শ বছর পরেও এখনও এ গ্রন্থ মুদ্রিত হয় তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তিনি কেবল লেখাপড়া শেখানোর কৌশল হিসেবে এগুলি লেখেননি, বরং ছাত্রদের নীতি বোধ উন্নত করা এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানও তাঁর লক্ষ্য ছিল অন্যান্য সাহিত্য গ্রন্থের মধ্যে 'বেতাল পঞ্চ বিংশতি', 'শকুন্তলা',  'সীতার বনবাস', 'ভ্রান্তিবিলাস', প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য  
 বিদ্যাসাগর মশাই সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন । বঙ্গদেশে কয়েকটি জেলার স্কুল পরিদর্শনের ভার ছিল তাঁর উপর । ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর গ্রাম বীরসিংহে একটি অবৈতনিক 'ইঙ্গ সংস্কৃত বিদ্যালয়' স্থাপন করেন  বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে থাকার সুযোগে তিনি ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন তিনি বহু গরীব মানুষের অন্ন বস্ত্রের ব্যবস্থা করে দিতেন । বহু গরীব ছাত্রদের নিয়মিত পড়ার খরচ দিতেন । দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ব্যয় বহন করার জন্য তিনি তার বেশিরভাগ বেতন ব্যয় করেন দেশের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করার জন্য স্কুল, গরীব লোকদের চিকিৎসার জন্য দাতব্য চিকিৎসালয়, গরীব ছেলে মেয়েদের  থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন । শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টার ত্রুটি ছিল নাতিনি স্কুল স্থাপনের জন্যে ধনী জমিদারদের উৎসাহ প্রদান করেন তিনি তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী দৃঢ় ও অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাজ করে গিয়েছেন ।
 প্রাতঃস্মরণীয় এই মনীষী ১৮৯১ সালের ২৯ শে জুলাই দেহ ত্যাগ করেন । তার মহাপ্রয়াণ ঘটেছে ঠিকই কিন্তু মানুষের মনে আজও তিনি অমর হয়ে আছেন
  আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে বা আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্ট টি পৌঁছেদিতে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুণ । জীবনী বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে জীবনী  লেখাটির উপর ক্লিক করুণ । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।

আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।
 

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ধন্যবাদ

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷