রবিবার, ২৯ মার্চ, ২০২০

তাজ মহল কে, কবে, কেন তৈরি করেন ?.


তাজ মহল কে, কবে, কেন তৈরি করেন ?.

তাজমহল হল ভালোবাসার অনন্য প্রতীক । মধ্যযুগীয় সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটি আশ্চর্য । বিশ্ববাসী তাজমহলকে এক পলক দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে । তাজমহল মুঘল মুসলিম স্থাপত্য কীর্তি গুলোর মধ্যে গৌরবান্বিত অলঙ্কার, একটি অনন্য কীর্তি । তাজমহলকে ‘ভালোবাসার’ প্রতীক হিসেবে ধরা হয় । মুঘল সম্রাট শাহ জাহান তাঁর প্রিয় স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তাজমহল তৈরি করেছিলেন । 
স্ত্রী মমতাজ মহলের অকাল মৃত্যুতে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের মনে খুব আঘাত লাগে । সেই ভেঙ্গে পড়া মন নিয়ে তিনি স্ত্রীর কবরের উপর একটা সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন । সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের স্মৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা জানাতেই তাজমহল তৈরি করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান ভারতের উত্তর প্রদেশে আগ্রায় অবস্থিত এই রাজকীয় সমাধি ।

 আরজুমান আরা বেগমের সঙ্গে শাহ জাহানের প্রথম দেখা হয় ১৬০৭ সালে । আরজুমান আবার পিতৃকুল দিক থেকে ছিলেন পারস্যের বেশ সমৃদ্ধিশালী পরিবার । তাঁর বাপ-দাদারা মোগলদের দরবারে বেশ সম্মানজনক পেশায় নিযুক্ত ছিলেন । ১৪ বছরের ইরানী কিশোরী মমতাজের দৈহিক সৌন্দর্য শাহজাহানকে বিমোহিত করে ফেলেছিল । শাহজাহান পরে তাঁর নামকরণ করেন ‘মমতাজ মহল’ । তিনি এ কিশোরীর সাথে বাগদান সম্পন্ন করেন, কিন্তু তাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নেননি । বরং মমতাজকে ঝুলিয়ে রেখে শাহজাহান আরেক নারীকে বিয়ে করেন ।
 বাগদানের ৫ বছর পর ১৬১২ সালে মমতাজকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে প্রাসাদে নিয়ে আসেন শাহজাহান । মুঘল সম্রাট শাহ জাহান কে বিয়ে করার আগে মমতাজের অন্য এক জনের সাথে বিয়ে হয়েছিল। শাহ জাহান মমতাজের প্রথম স্বামী কে নির্মম ভাবে হত্যা করেন, তারপর মমতাজকে বিয়ে করেন । আবার ১৬১৭ সালে তিনি আরো এক নারীকে বিয়ে করেন মমতাজ সহ দুই স্ত্রী ঘরে থাকা সত্ত্বেও । এদিকে বিয়ের ১৯ বছরের মধ্যে মমতাজ শাহজাহানের ১৪ সন্তানের মা হন । ১৪তম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মমতাজ মারা যান, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে । তাঁর মৃত্যুও হয় সন্তান প্রসবের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ।

 মোগল সম্রাটদের মধ্যে শাহজাহান ছিলেন বেশ বিলাসী । যার ফলস্বরূপ ভারতবর্ষ জুড়ে গড়ে উঠেছিল এমন সব শৈল্পিক নিদর্শন, যা এখন পর্যন্ত ভ্রমণ প্রিয় মানুষের দৃষ্টিকে ভারতের দিকে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে । তাজমহল বিশ্বের অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ ও মনোমুগ্ধকর নিদর্শন । তাজমহলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৩২ সালে যমুনা নদীর তীরে এবং পুরোপুরি শেষ হয় ১৬৫৩ সালে । এ সময়কালে ২০,০০০ শ্রমিক ও কারিগর তাজমহল নির্মাণে দাসদের মতো ব্যবহৃত হয়েছিল । যারা ছিলেন শ্রমিক, স্টোন কাটার, চিত্রশিল্পী, সূচিকর্ম শিল্পী ও ক্যালিগ্রাফি । 
তাজমহল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নকশার উপর, বিশেষ করে পারস্য ও মুঘল স্থাপত্য অনুসারে । দরজাটির নকশা ও ধরন মুঘল সম্রাটদের স্থাপত্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় । তাজমহলের মূল হল তার সাদা মার্বেল পাথরের সমাধি । সমাধিটি একটি বর্গাকার বেদিকার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে । তাজমহলে ঢোকার প্রধান ফটক বা দরজাও তৈরি হয়েছে মার্বেল পাথরে ।

 সমাধির উপরের মার্বেল পাথরের গম্বুজই সমাধির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য । বড় গম্বুজটির গুরুত্বের কারণ এর চার কোণায় আরও চারটি ছোট গম্বুজ রয়েছে । ছোট গম্বুজগুলোও দেখতে বড় গম্বুজটির মত । বড় গম্বুজের উপর মুকুটের মত একটি পুরনো মোচাকার চূড়া রয়েছে । চূড়াটি ১৮০০ শতকের আগে স্বর্ণের নির্মিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে এটি ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি ।
 তাজমহলের নির্মাণ সামগ্রী বহনের জন্য ১০০০ হাতি ব্যবহার করা হয়েছিলো । স্থাপত্যকলার এই বিশাল জাঁকজমক পূর্ণ কাজটি করার জন্য সম্রাট রাজস্থান, আফগানিস্তান, তিব্বত ও চীন থেকে মার্বেল পাথর আনিয়েছিলেন । এছাড়াও ২৮ ধরণের মূল্যবান ও আধা মূল্যবান পাথর সাদা মার্বেলের উপর বসানো হয়েছিলো । যার মধ্যে আকর্ষণীয় নীলকান্তমণি ও ছিল । এটি ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন ।

 তাজমহলের উচ্চতা ১৭১ মিটার বা ৫৬১ ফুট দীর্ঘ যা কুতুবমিনারের চেয়েও বড় । তাজমহলের স্থাপত্যকলা ছিল বিশ্বব্যাপী অনুপ্রাণিত । এটি পারস্য, মধ্য এশিয়া ও ইসলামী স্থাপত্যের সমন্বয় করেছিলো । এই অনন্য স্থাপনাটির স্থপতি ছিলেন আহমেদ লাহোরি । কথিত আছে, তাজমহল নির্মাণ শেষে কারিগরদের হাতের আঙ্গুল কেটে দেয়া হয় যাতে তারা অন্য কোথাও আবার এ কাজ করতে না পারে, যদিও এ গল্পের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় না ।
 তাজমহল নির্মাণে তখনকার সময়ের ৩২ মিলিয়ন রুপি খরচ করেছেন । তাত্ত্বিক হিসাব অনুযায়ী, এ পরিমাণ অর্থ বর্তমানের ৫২.৮ বিলিয়ন রুপি বা ৮২৭ মিলিয়ন ইউএস ডলারের সমান, অর্থাৎ ৬,৪৩৮ কোটি টাকার সমান । এ পুরো টাকাটাই ছিল সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে আদায় করা খাজনা । শাহ জাহান এ টাকাই ব্যয় করেছেন নিজের মৃত স্ত্রীর কবরের উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মতো ব্যক্তিগত অভিলাষ পূরণের জন্য । এই বিশাল পরিমাণ অর্থ খরচ করা আর সেই অর্থ আদায় করতে গিয়ে জনগণের উপর চালানো অত্যাচারের কুফল হিসেবে তাজমহল নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় ।

শাহজাহানকে কি আদৌ প্রেমিক বলা যায়? মমতাজের প্রতি তাঁর যে অনুভূতি ছিল সেটাকে স্রেফ মোহ ছাড়া আর কিছু বলার উপায় নেই । মমতাজ কিন্তু শাহজাহানের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন না । শাহজাহানের অন্তত আরও তিনজন স্ত্রী ছিলেন, এমনকি মমতাজের পরও তিনি আরও একটি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন । মমতাজের মৃত্যুর বছর পাঁচেক পর তাঁরই ছোট বোনের সঙ্গে নাকি বিবাহবহির্ভূত অন্তরঙ্গ এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ।
তাজমহলের নির্মাণ কাজ শেষ হতে না হতেই শাহ জাহান তার পুত্র আওরঙ্গজেব দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত ও আগ্রার কেল্লায় গৃহবন্দী হন । আওরঙ্গজেব শাহ জাহানকে জোর করে বন্দি করে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন । শাহজাহানকে তাঁর জীবনের শেষ ৮ বছর আগ্রার দুর্গে গৃহবন্দি হয়ে থেকেই কাটাতে হয় । মুকুটহীন বৃদ্ধ শাহজাহান বন্দিশালার এক ক্ষুদ্র জানালা দিয়ে মাঝেমধ্যে চেয়ে দেখতেন তাঁর সেই অমর কীর্তি । বন্দি জীবনে শাহজাহানের সঙ্গী ছিল জাহানারা, যার প্রেমিককে শাহজাহান নৃশংসভাবে খুন করেছিলেন । জাহানারা স্বেচ্ছায় পিতার সাথে বন্দি হয়ে দুঃসময়ে পিতাকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন । বন্দি অবস্থায়ই তিনি মারা যান । শাহ জাহানের মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব তাকে তাজমহলে তার স্ত্রীর পাশে সমাহিত করেন ।
 বর্তমানে, তাজমহলে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন পর্যটক আসে যার মধ্যে ২,০০,০০০ পর্যটক বিদেশী, যা ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ।

আমাদের লেখা আপনার কেমন লাগছে বা আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তবে নিচে কমেন্ট করে জানান । আপনার বন্ধুদের কাছে পোস্ট টি পৌঁছেদিতে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুণ । ইতিহাস ও জানা অজানা বিষয়ে আরও পোস্ট পড়তে নিচে ইতিহাস ও জানা অজানা লেখাটির উপর ক্লিক করুণ । পুরো পোস্ট টি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।  
আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে আপনার প্রয়োজন অনুসারে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ধন্যবাদ

মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷